খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম। সেক্টর ২-এর এই অধিনায়ক রণাঙ্গনে আহত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টেও ঘটনায় ফারুক-রশীদ খুনি চক্রের বিরুদ্ধে ৩ নভেম্বর এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন, যা ব্যর্থ হয়। ৭ নভেম্বর এক পাল্টা অভ্যুত্থানের পর অত্যন্ত নির্মমভাবে তিনিসহ আরও দুই মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আজও রহস্যাবৃত। এই ঘটনা নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন খালেদ মোশররফের বড় মেয়ে সাবেক সংসদ সদস্য মাহজাবিন খালেদ। ২০২২ সালে নেওয়া অপ্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারটি দেশ রূপান্তরে প্রকাশ করা হলো।
রাহাত মিনহাজ : ১৯৭৫ সালে আপনার বয়স কত ছিল। আপনার বাবার সেই দিনের কিংবা তার আগের কোনো স্মৃতি আপনাকে আজও কি ছুঁয়ে যায়?
মাহজাবিন খালেদ : ১৯৭৫ সালে আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি, বয়স আট। মুক্তিযুদ্ধের পর পর আমার বাবা (খালেদ মোশাররফ) সেনাবাহিনী গঠনসহ অন্যান্য কাজে খুবই ব্যস্ত ছিলেন। উনার বাড়ি ছিল জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানায়। ইসলামপুর থেকে অসংখ্য লোক আসতেন। দুপুরের পর থেকে তাদের সময় দিতেন। এ ছাড়া আর্মির লোকজন তো আছেই। তারা আসতেন। তাই বাবার সঙ্গে খুবই কম সময় পেয়েছি। আমরা রবিবার বাবাকে কাছে পেতাম। ওই দিনটাতে আমরা পারিবারিক সময় কাটাতাম। তিনি খুব গাড়িপাগল ছিলেন। রবিবার বাবার সঙ্গে নানিবাড়িতে দুপুরের খাবার খেতে হবে এবং সকালবেলা যেতে হবে ড্রাইভে। এই দুটো আমার খুব মনে পড়ে।
রাহাত মিনহাজ : আপনি যখন বড় হয়েছেন, ৭ নভেম্বরের ঘটনাটা আপনি আপনার মায়ের কাছে শুনেছেন। আমরা জানি, ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশে একটা অন্যরকম অবস্থা বিরাজ করছিল। ৩ নভেম্বর কর্নেল শাফায়াত জামিলকে সঙ্গে নিয়ে যে চেষ্টাটি খালেদ মোশাররফ করেছিলেন। ওই ঘটনাপ্রবাহের পর খালেদ মোশাররফ কেমন ছিলেন, তিনি কি কাজ করছিলেন?
মাহজাবিন খালেদ : আমার বাবা ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের এক তারিখে আমাদের তিন বোন (মাহজাবিন, আম্মেরিন ও তাইরিন খালেদ) এবং মাকে নানিবাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তিনি হয়তোবা চিন্তা করেছিলেন কিছু একটা ঘটবে। It’s not safe in cantonment. Actually, it wasn’t safe in cantonment. . নভেম্বরের এক তারিখ থেকে ছয় তারিখ পর্যন্ত আমরা খুব একটা কিছু জানি না। কারণ বাবা তখন বঙ্গভবনে ছিলেন। সেখানে যোগাযোগও করা সম্ভব হয়নি। ঠিক পাঁচ তারিখে আমার মাকে ফোন করে বলছেন, তুমি বাচ্চাদের নিয়ে কালকে এসো। কাল সারাদিন একসঙ্গে থাকব। ছয় তারিখে আমরা দেখা করতে গিয়েছি, সারাদিন আমরা বাবার সঙ্গে কাটিয়েছি। তার মধ্যেও তিনি খুবই ব্যস্ত ছিলেন। আর্মি অফিসাররা আসছিলেন, যাচ্ছিলেন। অনেক সাংবাদিকও আসছিলেন। তাদের সঙ্গে মিটিং চলছিল। কিন্তু কী বিষয়ে মিটিং, সেটা আমি বলতে পারব না। কিন্তু কিছু একটা হচ্ছিল। আমার মাকেও তিনি সবকিছু জানাননি। তবে একটা ঘটনা ঘটবে, সেটা বোঝা যাচ্ছিল। ছয় তারিখ এভাবেই সেনানিবাসে কাটিয়ে সন্ধ্যাবেলা আমরা চলে আসি নানিবাড়ি। তারপর তো আর কিছুই জানি না। হঠাৎ শুনলাম আমার বাবাসহ দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাদের মরদেহ সিএমএইচে আছে। মরদেহ আনতেও আট তারিখ পর্যন্ত কেউ যেতে চায়নি। কেউ ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার সাহস পাচ্ছেন না। পরে আমার মায়ের একজন চাচা ছিলেন, একটু বয়স্ক ব্যক্তি, উনি রাজি হয়েছিলেন সিএমএইচে গিয়ে বডি নিয়ে আসতে। বাবাকে দাফন করা হয় নেভির গোরস্তানে। মৃত্যুর ২ দিন পর।