আমাদের প্রাথমিকের কারিকুলাম যোগ্যতাভিত্তিক হলেও মাধ্যমিকের কারিকুলাম ২০১২ সাল থেকে শিখনফল ভিত্তিক। শিখনফলভিত্তিক কারিকুলামে শিক্ষার্থীর নিজস্ব সৃজনশীলতা আর কল্পনার জগৎ থাকে উপেক্ষিত, তথ্য স্মরণে রাখার বিষয়টিই মুখ্য। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চালু হওয়া নতুন কারিকুলামে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-শেখানোর মাধ্যমে যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটি প্রথম শ্রেণি, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি ও মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হতে যাচ্ছে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায় নতুন কারিকুলাম পরীক্ষাবিহীন পড়াশুনার মতো মনে হচ্ছে অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে।
সাধারণত আমরা পড়াশুনা নিয়ে ছেলেমেয়েদের ভীষণ ব্যস্ত রাখার পরিবেশে অভ্যস্ত যেখানে প্রচুর হোমওয়ার্ক থাকবে, টিউটরের কাছে ও কোচিংয়ে দৌড়াদৌড়ি থাকবে। তাহলেই না শিক্ষার্থী কিছু শিখছে বলে মনে হয় অনেকের কাছে। তবে, এ কথাও ঠিক যে, বাচ্চাদের বিভিন্ন শিক্ষামূলক কাজে ব্যস্ত রাখা কিন্তু শিক্ষার অপরিহার্য অংশ যদি সেই ব্যস্ততা ফলপ্রসূভাবে করানো হয়ে থাকে। ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়তে বসবে, পরীক্ষা নামক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে- এটি আমাদের বহুদিনের শিক্ষা কালচার। উত্তরপত্রে যদি শিক্ষার্থীরা কিছু না-ই লিখে তাহলে শিক্ষকরা তাদের কীভাবে মূল্যায়ন করবেন আর অভিভাবকরাই বা কী বুঝবেন? নতুন কারিকুলামে মাউশির নির্দেশনা অনুসারে ৪০ শতাংশ মূল্যায়ন কিন্তু সামষ্টিক আর বাকি ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের অবিরত অবলোকনের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। এই ৪০ শতাংশ সামষ্টিকের বিষয়টিকে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন যে লিখিত পরীক্ষা হবে, কিন্তু সেটি দেখা যাচ্ছে না।
শ্রেণিকক্ষের এবং মাঠপর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে চিত্র সেটি কিন্তু আনন্দের নয়, বরং ভয়াবহ। শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাচ্ছে না, গেলেও যাচ্ছে আর আসছে, কিছুই পড়ছে না, লিখছে না। আগে লিখিত পরীক্ষার তাড়না থাকায় শিক্ষার্থীরাও মোটামুটি ক্লাসে আসত এবং অভিভাবকরাও শিক্ষার্থীরা কিছু শিখছে বলে মনে করতেন। কিন্তু লিখিত পরীক্ষা নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়াতে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে আসছেন না। অভিভাবকও সেভাবে তাড়া দিচ্ছেন না। অন্যদিকে নতুন কারিকুলামে পাঠদান পদ্ধতি আগের চেয়ে একটু বেশি প্রস্তুতি বা কর্মসম্পাদনমূলক হওয়ায় কেউ কেউ এটাকে কষ্টসাধ্য পদ্ধতি হিসেবেই মনে করছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু ব্যয়সাপেক্ষও বটে। আগের পদ্ধতিতে সাধারণভাবে শিক্ষকরা একই প্রস্তুতিতে যুগ যুগ ধরে শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন। নতুন কারিকুলাম বিষয়ে তাদের অনেকে ভাবছেন নিত্যনতুন চিন্তার প্রয়োগ সময়, শ্রম এবং ব্যয়সাপেক্ষ। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া বেশ ঝামেলাযুক্ত যা অধিকাংশ শিক্ষকদের পক্ষে সামাল দেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে যেসব বিদ্যালয় একটু তৎপর সেখানকার ছেলেমেয়েরা প্রচুর প্রজেক্ট ওয়ার্ক করছে যা অনেক অভিভাবক বলছেন সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।