ভারতের চন্দ্রযান -৩ এর সাফল্য নিয়ে দেশবাসী এখন আনন্দে উদ্বেল। কিন্তু ভারতের মহাকাশ গবেষণার এই প্রযুক্তি অর্জন করতে গিয়ে কতজন বিজ্ঞানীর প্রাণ গেছে তার সঠিক হিসেবে নেই। অনেকেরই অজানা। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে একের পর এক বিজ্ঞানীর মৃত্যু রহস্য ঠেকাতে পারেনি আজ ইসরো সাফল্য। আর তা এখন সবারই জানা।
শুরুটা হয়েছিল ভারতে পরমাণু গবেষণার জনক হোমি জাহাঙ্গির ভাবাকে দিয়ে। ১৯৬৬ এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭০৭ –এ ভিয়েনার যাওয়া পথে আল্পস পর্বতের ওপর ভেঙে পড়ে বিমান। ওই ঘটনায় নিহত হন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি হাতে আসা তথ্য বলছে অন্য কথা। ওয়াকিবহাল মহলের অভিযোগ, সাংবাদিক গ্রেগরি ডগলাস আর তৎকালীন সিআইএর অফিসার রবার্ট টি ক্রাইলের কথোপকথনের ট্রান্সক্রিপ্টে স্পষ্ট, এর পেছনে হাত ছিল মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ’র। কারণ,ষাটের দশকেই পরমাণু শক্তিধর দেশ হয়ে ওঠার পথে অনেকটা এগিয়ে যায় ভারত। সিআইএ কর্মকার্তার বক্তব্য ছিল, ‘.. the thing is, they were getting into bed with the Russians.’ ভাবার এই রহস্যমৃত্যুকে ভারতের পরমাণু গবেষণা পিছিয়ে যায় কয়েক দশক।
যার নামে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার সেই বিক্রম সারাভাই ভারতের মহাকাশ গবেষণার প্রাণপুরুষ ছিলেন। ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত ‘ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিক্রম। এই সংস্থা-ই ইসরোর পূর্বসূরি। ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর রহস্যমৃত্যু হয় সারাভাইয়েরও। কেরলের কোভালাম বিচে তার প্রিয় রিসোর্টে মরদেহ উদ্ধার পাওয়া যায়। কীভাবে মৃত্যু? জানা নেই, কারণ পোস্ট মর্টেম করা হয়নি। বিক্রম সারাভাইয়ের সহকর্মী কমলা চৌধুরী দাবি করেছিলেন, ‘মৃত্যুর কয়েকদিন আগে থেকে নাকি সারাভাই তাকে বলছিলেন, আমেরিকা ও রাশিয়া তার ওপর কড়া নজর রাখছে। কড়া নিরাপত্তার বেষ্টনির মধ্যে থেকেও শেষ রক্ষা হয়নি।
ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জির সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১১ জনের বিভিন্নভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। যাদের মৃত্যুরহস্যের আজও কিনারা হয়নি।
২০০৯ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী লোকনাথ মহালিঙ্গমের রহস্যজনক মৃত্যুকে আত্মহত্যার তকমা লাগিয়ে তদন্ত শেষ করে দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে মহালিঙ্গমের মরদেহ যে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল, পাঁচ বছর আগে ভারতের নিউক্লিয়ার পাওয়ার করপোরেশন (এনসিপি)-এ কর্মীকে ওই জঙ্গল থেকেই অপহরণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু কোনও মতে পালিয়ে তিনি প্রাণে বাঁচেন। তবে রবি মুলে নামের অন্য এক এনসিপি কর্মীকে সপ্তাহ খানেক আগেই খুন করা হয়। পুলিশ এ ঘটনার তদন্তে অগ্রগতি আনতে ব্যর্থ হয়। ধামাচাপা পড়ে যায় মামলাটি।
২০১১ সালে এপ্রিলে সাবেক বিজ্ঞানী ঊমা রাওয়ের রহস্যজনক মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এবারেও তদন্তকারীরা ঘোষণা করেন আত্মহত্যা করেছেন রাও। যদিও ওই বিজ্ঞানীর পরিবার তদন্তকারীদের দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানান। এদের মধ্যে সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা ছিল বিজ্ঞানী এম আইয়ারের ক্ষেত্রে। তার খুলিতে অভ্যন্তরীণ ক্ষত পাওয়া যায়। এম আইয়ারের খুলির ভেতর কীভাবে ক্ষত হল এ নিয়ে মাথা ঘামানোরও চেষ্টা করেনি পুলিশ।
চেতন কোঠারির নামে একজন আরটিআই আন্দোলকারীর আরটিআইয়ে জানা যায় ১৯৯৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ইসরোর’র ৬৮৪ জনের রহস্যমৃত্যু ঘটছে। ইসরোর তৎকালীন কর্তৃপক্ষ এসব মৃত্যুকে কাজের চাপে আত্মহত্যা জাতীয় কিছু বলে পাশ কাটিয়ে যায়। ইসোর সাবেক বিজ্ঞানী নাম্বি নারায়ণনকে গুপ্তচরবৃত্তির মিথ্যা অভিযোগে জেল খাটতে হয়। পরে তাকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বেকসুর খালাস দেন। সম্প্রতি নারায়ণনকে ৫০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন আদালত। এই বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, মালদ্বীপের দুই গুপ্তচরের কাছে তিনি পাচার করেছেন ক্রায়োজনিক পদ্ধতির ফর্মুলা। ১৯৯৪ সালে যখন তাকে গ্রেফতার করা হয়, তখন ওই পদ্ধতি ঠিকমতো বোঝার মতো ভারতে কেউ ছিলেন না। বেকসুর খালাসের পর, ইসরোতেই ক্রায়োজনিক ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। নারায়ণনের সঙ্গেই ডি শশীকুমারন নামে আরেক বিজ্ঞানীকেও একই ভাবে ফাঁসানো হয়েছিল। নারায়ণনকে ৫০ দিন জেলে কাটাতে হয়।
নাম্বি নারায়ণনের অভিযোগ ছিল, জেলে তাকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। ইসরোরই আরেক বিজ্ঞানী, নারায়ণনের বস, এ ই মুত্থুনায়াগমকে এর সঙ্গে জড়াতে চাওয়া হয়েছিল। তাকে দিয়েই মুত্থুনায়াগমের নাম নেওয়াতে চাপ দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ। এমনকি সেই সময় ইসরোও নারায়ণনের পাশে দাঁড়ায়নি। নাম্বি নারায়ণনকে নিয়ে দক্ষিণে একটি সিনেমাও হয়েছে।
কেনও নাম্বি নারায়ণনের মতো এত বড় বিজ্ঞানীকে এভাবে ফাঁসানো হয়েছিল?। অনুমান করা হয়– সেই সময় ভারত সদ্য পিএসএলভি রকেট লঞ্চ করেছিল। নারায়ণন সেই মিশনের প্রজেক্ট ডিরেক্টরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। আরও উন্নতর ক্রায়োজনিক পদ্ধতির দিকে এগোচ্ছিলেন বিজ্ঞানী। তবে কী ভারতের দৌড় থামাতে সেই সময় নারায়ণনকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল কোনও দেশ! আজ যা সম্ভব হচ্ছে না মোদি সরকারের দৌলতে।