বাংলাদেশে সবসময় যা হয়, দ্রব্যমূল্য বাড়লে সহজ সিদ্ধান্তে পৌঁছাই, ব্যবসায়ীরা তা বাড়াচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বাড়াচ্ছেন তা হয়তো আংশিক সত্য স্বল্প মেয়াদে, বাজারে অস্থিরতার জন্য তাদের দায় আছে বৈকি। কিন্তু বাজার অর্থনীতি তো চাহিদা-জোগানের চক্রে পরিচালিত হয়। কোনো কারণে দাম যদি বেড়ে যায়, ব্যাখ্যা কী হতে পারে—দাম বেড়েছে মানে চাহিদা বেড়েছে, সরবরাহ একই আছে। অথবা দেখা গেছে, চাহিদা একই আছে, সরবরাহ কমেছে। মোট কথা, অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এখন ঘাটতি চাহিদার দিক থেকে আসতে পারে, আবার সরবরাহের দিক থেকেও আসতে পারে। বোঝার উপায় আছে—চাহিদা বাড়ার কারণে দাম বেড়েছে, না সরবরাহ কমার কারণে দাম বেড়েছে। তার জন্য দরকার তথ্য-উপাত্তের।
এখন প্রশ্ন হলো, বাজার অর্থনীতি বললে চাহিদা-সরবরাহের যে ওঠানামা থাকে, তাতে দামের হ্রাস-বৃদ্ধিও থাকে। এখন দামের হ্রাস-বৃদ্ধি আমরা টার্গেট করছি, নাকি তার লেভেলটা টার্গেট করছি। লেভেল যদি বলি, আমাদের ১৯৭১-এ পণ্যের যে দাম ছিল, সেখান থেকে মূল্য গড়ে ৪০-৫০ গুণ বেড়েছে। যদি গড়ে ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ধরা হয়, তাহলে ১৯৭১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সময়টা ধরলে ৩২ গুণ দাম বাড়ার কথা, কিন্তু তা আরো বেশি বেড়েছে নানা কারণে। সে হিসাবে মোটা দাগে প্রায় ৪০ গুণ দাম বেড়ে গেছে। এ দামটা কেন বেড়েছে? সরকারের পলিসি টার্গেটই মূল্যস্ফীতি ধরে রাখে। উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতি হজম করতে হয়। উচ্চপ্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বেশি রাখতে হয়, তাতে ব্যাংক বেশি ক্রেডিট দিতে পারে, বিনিয়োগ বেশি হয়। ফলে চাহিদা বেশি হয়। সেগুলোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান বেশি হয়, প্রবৃদ্ধি বেশি হয়। সরকারের পলিসির মধ্যেই আছে প্রতি বছর কীভাবে দাম বাড়ানো হবে। প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ হলে যদি ১৫ শতাংশ টাকা সরবরাহ বাড়ানো হয়, তাতে ৬ বা ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়। তাহলে সরকারের ওই পলিসির কারণে যেটা হচ্ছে, ১৯৭১-এর প্রাইস লেভেল থেকে ৪০ গুণ দাম হয়ে গেছে। এখন যেহেতু মানুষের উপার্জন সবার একই হারে বাড়েনি বা যারা চাকরি করে তাদের ক্ষেত্রে অ্যাডজাস্টমেন্ট ধীরে হয়। এতে প্রকৃত উপার্জনের দিক থেকে সাংঘাতিক একটা অসমতা তৈরি হয়েছে, হয়েছে ভোগের দিক থেকেও। এজন্য দায়ী কে? ব্যবসায়ীরা সরবরাহ-চাহিদার মধ্যে থেকে দামের ওঠানামাকে প্রভাবিত করছেন। কিন্তু দামের লেভেল বা দামস্তর বাড়ার মূল কারণ অবশ্যই সরকারের নীতি। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর নীতির মধ্যেই মূল্যস্ফীতি রয়েছে। উৎপাদনের খরচ যখন বাড়বে, উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়বে। তাহলে ব্যবসায়ীদের ধরা হচ্ছে কেন? সবসময় যেটা হয়—সরকারের নীতিগত কারণে যে দাম বাড়ছে তা আমরা ফোকাস করি না। কোনটা ফোকাস করি? যেমন কোনো কারণে দেখা গেল হঠাৎ করে দাম বেড়ে গেছে। কোনো কারণে চাহিদা বেড়ে গিয়ে দাম বাড়তে পারে, অনেক সময় যেটা হয়—চাহিদা বাড়েনি, সরবরাহ হঠাৎ করে কমে গেল। সরবরাহ কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে যেটা হয়, ইনভেন্টরিতে আছে, স্টকে আছে কিন্তু কোনো কারণে যদি ব্যবসায়ীরা ভাবেন সামনে দাম বেড়ে যাবে তাহলে তারা বাজারে কম সরবরাহ করেন। আজ যদি কম সরবরাহ করা হয়, তাহলে কী হবে, দাম বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা এক্ষেত্রে কারসাজি করছেন তা বলা যাবে না সবসময়। ব্যবসায়ীদের কাছে যদি অভিন্ন কিছু তথ্য থাকে যে একটি পণ্যের মজুদ কম থাকায় সামনের দিকে সেটার দাম ১০-১৫ শতাংশ বেড়ে যাবে, তখন তারা প্রত্যাশাজনিত কারণে পণ্য ধরে রাখবেন কয়েক সপ্তাহ। ধরে রাখলে কী হতে পারে? দাম বেড়ে যাবে, এটা কিন্তু বাজারের ভাষা। কোনো কারণে যদি ঘাটতি তৈরি হয়, তাহলে সুবিধা নেবে কে? সরবরাহ সাইডের লোকজন সুবিধা নেবে। যদি কোনো কারণে উদ্বৃত্ত তৈরি হয়, তাহলে কী হবে? ভোক্তা এর সুবিধা নেবে এবং নিচ্ছে। এখন আমি যদি সুযোগ নেয়াকে বাজারের ভাষা বলি, তাহলে সরবরাহ-চাহিদায় যখন প্রত্যাশা তৈরি হবে, ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত তৈরি হবে, তাহলে তো এটির সুযোগ কোনো পক্ষ নেবেই। এটা স্বাভাবিক, এটাকে অস্বাভাবিক বলে সিন্ডিকেট সিন্ডিকেট বলে সবসময় চিৎকার করা যাবে না। ব্যবসায়ীদের একটা গোষ্ঠীকে সবসময় শায়েস্তার চেষ্টা করা হচ্ছে। সয়াবিন তেল প্রতি মেট্রিক টন ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১ হাজার ৪৫০ ডলার, ওখান থেকে যখন দু-তিন মাসের ব্যবধানে ১ হাজার ৯০০ ডলারে চলে গেল। তার মানে দেখা যাচ্ছে, প্রতি লিটারেই ক্রুড অয়েলে ৫০ টাকার মতো দাম বেড়ে গেছে। দাম বাড়লে আল্টিমেটলি কী হবে? এটার সমন্বয় তো ব্যবসায়ীরা করবেনই। বাড়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় যেটা হয়, যেটা কম দামের সেটা বেশি দামে বিক্রির চেষ্টা করা হয়। আবার অনেক সময় দাম বিশ্ববাজারে কমে গেলেও আগে বেশি দামে কিনেছেন বলে তিনি হয়তো দাম ধরে রাখার চেষ্টা করেন, এগুলো তো হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু মূল কথা হলো, এ ওঠানামা তো চাহিদা-সরবরাহের কারণে হবে। দীর্ঘমেয়াদে মূল্য যে ৩৫-৪০ গুণ হয়ে গেল, সেটা হলো সরকারের নীতির কারণে। মূল্যস্ফীতির কারণে উৎপাদন খরচ বাড়ে যা আবার মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। পাশাপাশি বিশ্ববাজারের দাম এবং বৈদেশিক বিনিময় হারের বৃদ্ধি একে বাড়ায় দীর্ঘমেয়াদে।