একটি রাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন করা হয় মানুষের জন্য। কিন্তু সেই আইন যদি মানুষকে ভীত করে তোলে, যদি দেশে একটা ভয়ের সংস্কৃতি চালু করে তবে প্রশ্ন উঠবেই যে, সে আইন কীসের আইন? কার জন্য আইন? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এমন একটি আইন যার নাম শুনলেই মানুষ আতঙ্ক বোধ করে। মানবাধিকার ও সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, লেখক, কার্টুনিস্ট, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ—অতি অল্প সময়ে এ আইনে নিপীড়িত হওয়ার তালিকাটা অনেক দীর্ঘ।
দেশ-বিদেশে তুমুল সমালোচনা, ব্যাপক হারে আইনের অপপ্রয়োগের পাঁচ বছরের মাথায় এসে সরকার বহু বিতর্কিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ বাতিল করে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩, আনার কথা ঘোষণা করল। গত সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠক-পরবর্তী ব্রিফিংয়ে বলা হয়, প্রস্তাবিত নতুন আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কঠোর সাজা থাকছে না, সাজার পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থাকা অজামিনযোগ্য ধারা কমিয়ে নতুন আইনে জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে।
এ আইনটি পাসের আগে এবং পরে দেশের সাংবাদিক সমাজ, নাগরিক সমাজ, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার কর্মীরা শত আর্জি জানিয়েও সরকারকে নড়াতে পারেনি। অবশেষে এ বছর এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফোলকার টুর্ক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগে অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানান। এরপর জুনে এ আইন পর্যালোচনা করে সংশোধনের একটি বিস্তারিত নীতিমালা সরকারকে পাঠানো হয় টুর্কের অফিস থেকে। সাম্প্রতিককালে নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিক ও সংস্থার আলাপেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ নিয়ে কথা ওঠে। অবশ্য আইনমন্ত্রী সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস গিল্ড, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার এবং সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক আলোচনায় এ আইনে সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধ করার উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে এ আইন সংসদে উত্থাপন করে মাত্র কয়েক মিনিটেই পাস করিয়ে নেয় সরকার। এ আইন পাস করে, প্রয়োগ করে এবং হাজারো সমালোচনার পরও বজায় রেখে সরকার বা দেশের কী লাভ হয়েছে সেটা পরিসংখ্যান দিয়ে কখনো জানাতে পারেনি। তবে এ আইন যে দেশে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, এতে সন্দেহ নেই। আইন চালু হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি ভুগেছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিক আর সাংবাদিকরা এবং অবশ্যই ভিন্নমতের রাজনীতিকরা। একটা পর্যায়ে দেখা গেছে অপপ্রয়োগ করা লাগেনি, প্রয়োগটাই অপপ্রয়োগ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সমাজবিরোধী ও দুর্নীতিবাজ, সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে নিপীড়নের অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলে এ আইনের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে এবং মূলত এ আইন যথেচ্ছ প্রয়োগের কারণে মতপ্রকাশের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে এসে ঠেকেছে। প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের করা বার্ষিক সূচকে ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান অবনতির দিকে ধাবমান। দেখা যায়, ২০১৬ সাল থেকে এক বা দুই ধাপ করে নামলেও ২০২২ সালে একলাফে ১০ ধাপ নেমে যায়। বলা হয়, এর বড় অবদান এসেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে।