বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল চরিত্র হচ্ছেন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। কিন্তু ইতিহাসে তিনি নিতান্তই উপেক্ষিত। বড়জোর বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী হিসেবে তাঁকে উল্লেখ করা হয়। অথচ তিনি না থাকলে দীর্ঘ লড়াইয়ের পথ অতিক্রম করে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হতে পারতেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বঙ্গবন্ধুর দিন কেটেছে মিটিং, মিছিল, দাবি, স্লোগান আর কারাবাসে। কিন্তু এ সময় তাঁর বৃদ্ধ মা-বাবা, সন্তানদের দেখভাল, সংগঠনের খবর বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছানো, বঙ্গবন্ধুর বার্তা নেতা-কর্মীদের কাছে নিয়ে আসা, এমনকি নেপথ্যে থেকে সংগঠন পরিচালনার কাজও ফজিলাতুন নেছাই করেছেন।
ফজিলাতুন নেছার এ অনন্য ভূমিকাকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘রেণু আমার পাশে না থাকলে এবং আমার সব দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, বারবার কারাবরণ, ছেলেমেয়ে নিয়ে অনিশ্চিত জীবনযাপন হাসিমুখে মেনে নিতে না পারলে আমি আজ বঙ্গবন্ধু হতে পারতাম না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামেও যুক্ত থাকতে পারতাম না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় সে আদালতে নিত্য হাজিরা দিয়েছে এবং শুধু আমাকে নয়, মামলায় অভিযুক্ত সবাইকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি জেলে থাকলে নেপথ্যে থেকে আওয়ামী লীগের হালও ধরেছে।’
বঙ্গবন্ধু বেগম ফজিলাতুন নেছার নানা পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন। নারীদের সহযোগিতার ইতিহাসকে পুরুষেরা যেন না ভুলে যায় এ প্রসঙ্গে নিজের স্ত্রী ফজিলাতুন নেছার দূরদর্শিতা ও অবদানের উল্লেখ করে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ খুলে আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত।
এমন সময়ও আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে লেখা হয়। মহিলার নাম বেশি ইতিহাসে লেখা হয় না। সে জন্য আজকে আপনাদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইয়েরা আমার, যখন কোনো রকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে।’