এই কদিন আগে ছিল শেখ কামালের জন্মদিন। মৃত্যুও তাঁর এই মাসে। সে মৃত্যু বড় নির্দয় বিবেচনাহীন। একটা কথা বলতেই হয়, সব সময় ভালো মানুষেরও ভালো মূল্যায়ন হয় না। এটাও এক ভাগ্যের ব্যাপার। ছোটবেলায় অনেক কিছুই ভালো লাগত না। কখনোসখনো মনে করতাম সবাই ভালো বলবেন। কিন্তু এ পৃথিবীতে সবাই সবাইকে কখনো ভালো বলে না। কারও কর্মকান্ড সব সময় সবার পক্ষে যায় না। কারও পক্ষে গেলে অবশ্যই কিছু না কিছু কারও না কারও বিপক্ষে যাবে। তাই এ পৃথিবীতে যত ভালো মানুষই হোন, কারও না কারও কাছে ভালো হওয়া যায় না। যেখানে স্বার্থ জড়িত থাকে সেখানে অনেক মানুষই স্বার্থান্ধ হয়ে সত্যকে সত্য বলে স্বীকার করতে চায় না, স্বীকার করে না। সেজন্য কামালের জন্ম এবং মৃত্যুর মাসে কেন যেন অন্তর থেকে তাগিদ অনুভব করি। সে কারণেই কামালকে নিয়ে দুই কথা লিখছি। ষাটের দশকে পাকিস্তান আমলে রাজনীতি, সমাজ, মানুষের মানবতা, আচার-আচরণ এমন ছিল না। তখন কোনো বাচ্চা হারিয়ে গেলে যার হাতেই পড়ত সে পাগল হয়ে যেত কীভাবে বাচ্চাটিকে বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এখন বাবা-মার কাছে পৌঁছানো নয়, বাচ্চা তুলে নিয়ে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। না দিলে শিশুদেরও মেরে ফেলা হয়। এমন অমানবিক আমরা কখনো ছিলাম না। পরম মানবতাই ছিল আমাদের গর্বের ধন। এখনো ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য যতটা সম্মান দেখায়, ভালোবাসে তার চাইতে হাজার গুণ বেশি সম্মান করে ভালোবাসে মায়ের ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যে সংগ্রাম করেছি, রক্ত দিয়েছি তার জন্য। কিন্তু এখন বাংলা, বাংলা ভাষার সেই মর্যাদা নেই, সেই দরদ নেই। দিন দিন কেমন যেন মানবতাহীন, শালীনতাহীন এক জড়পদার্থে পরিণত হয়ে যাচ্ছি। কামালকে আমি সেই ছোটবেলা থেকেই চিনি, জানি। ১৯৬০-’৬২ সাল থেকে জাতির পিতা মুজিব পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। বঙ্গবন্ধু যখন শেখ মুজিব ছিলেন তখন আমাদের টাঙ্গাইলের বাড়িতে বেশ কয়েকবার এসেছিলেন। ১৯৭২-এর ২৪ জানুয়ারি কাদেরিয়া বাহিনীর সমস্ত অস্ত্র যেদিন বঙ্গবন্ধুর পায়ের সামনে বিছিয়ে দিয়েছিলাম, সেদিনও বঙ্গবন্ধু আমাদের বাড়িতে মা-বাবাকে দেখতে যেতে চেয়েছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে ফোমিন তাঁর দেশের স্বীকৃতি নিয়ে টাঙ্গাইল এসেছিলেন। তাঁরই কারণে ওয়াপদা ডাকবাংলো থেকে বেরিয়ে সার্কিট হাউসে গিয়েছিলেন। সে-যাত্রায় জাতির পিতার আর আমার বাবা-মার সঙ্গে দেখা হয়নি। কিন্তু কদিন পরই আমার মা-বাবাকে আমন্ত্রণ করে কথা বলেছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের কাছের মানুষ, আত্মার আত্মীয়। সেই সুবাদে আমাদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। শেখ কামাল এক অসাধারণ সরল নিরহংকার মানুষ ছিল। ভয় কাকে বলে তা তাঁর জানা ছিল না। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি, ১১ দফা আন্দোলনের সময় দেখেছি ঢাকা কলেজের দুর্দান্ত প্রিন্সিপালের সামনে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মিছিল নিয়ে বেরোতে। খুব সম্ভবত তখনকার প্রিন্সিপালের নাম ছিল জালালউদ্দিন। সব আন্দোলনে শেখ কামালকে পাওয়া যেত।