১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহের ভেতরে ঐক্যবদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার যে সারবস্তু ছিল ব্রিটিশ শাসকদের জন্য সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভয়ের আসল কারণ। ১৯৪২ সালে কংগ্রেস যখন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দেয়, তখন মনে হয়েছিল নতুন ও আরও বড় মাপের একটি ১৮৫৭ বোধকরি আসন্ন। সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজ তখন পূর্ব সীমান্তে উপস্থিত; এই বাহিনীও ১৮৫৭’র আদর্শেই দীক্ষিত ছিল, ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং অসাম্প্রদায়িক। বিয়াল্লিশের পরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন আরও প্রবল হয়েছে; এবং ১৯৪৬-৪৭-এ তা দুর্দমনীয় আকার ধারণ করেছে। এই সময়ে নৌবাহিনীতে বিদ্রোহ, বিমান বাহিনীতে অস্থিরতা, সেনাবাহিনীতে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি সহমর্মিতা এসব দেখে ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি যে ভারতকে আর ধরে রাখা যাবে না, তাই নিজেদের হাতে-গড়া মধ্যবিত্তের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে, ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে তারা প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে প্রস্থান করেছে।
বিদেশি শাসক চলে গেছে, কিন্তু ১৮৫৭-তে মুক্তির যে স্বপ্ন জেগে উঠেছিল তা এখনো বাস্তবরূপ নিতে পারেনি। ভারতবর্ষ সেদিনও বহুজাতির দেশ ছিল, কিন্তু বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ তখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন সাম্রাজ্যবাদীরা বিতাড়িত হলে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাধিটা দেখা দিত না, জাতি সমস্যার মীমাংসা হতো, এবং খুব বড় যে-সমস্যাটা শ্রেণি সমস্যা, তার নিরসনের পথেও এগুনো যেত।
কিন্তু ১৮৫৭’র শিক্ষাটা আছে। সেটা কম ব্যাপার নয়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটা এখনো চলছে। ১৮৫৭ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, এই লড়াইয়ে আপসের কোনো স্থান নেই। বলছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্য চাই, কেবল যে দেশের ভেতরে তা নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও। বিশ্বজুড়ে মানুষ ওই সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে, আমাদেরও সেখানে থাকতে হবে। মূল দ্বন্দ্বটা জনগণের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের, সেটা আমাদের দেশে যেমন সত্য, সত্য তেমনি বিশ্বব্যাপী।