দুর্নীতি এখন বাংলাদেশে একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রথম প্রথম বড় কোনো দুর্নীতির ঘটনা ঘটলে মানুষের ভেতর বেশ প্রতিক্রিয়া হতো; এখন ধারাবাহিক দুর্নীতির ঘটনার কথা শুনতে শুনতে গা-সওয়া হয়ে গেছে। ভেবে কষ্ট লাগে, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ আজ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। আফসোস হয়, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতার হাতে গড়া যে রাজনৈতিক দলটি মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, সেই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শাসনামলেই বাংলাদেশ কিনা ধীরে ধীরে প্রতিকারবিহীন অপ্রতিরোধ্য একটি দুর্নীতিপ্রবণ দেশে পরিণত হয়েছে।
এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, শাসকগোষ্ঠী দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই তা আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থেকেও ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদে সমাজের চিহ্নিত দোষী ব্যক্তিরা যখন পার পেয়ে যায়, সাধারণ মানুষের ভেতর তখন হতাশার সৃষ্টি হয়। এই হতাশা কিছুদিন মানুষকে পীড়া দেয়, তারপর একসময় গা-সওয়া হয়ে যায়। দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। সরকারকে অনেকেই অনেকভাবে পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালত বহুবার হতাশাও ব্যক্ত করেছেন। তাতে কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। দুর্নীতি কমেছে— এমন প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। প্রশ্ন জাগে, দুর্নীতিবাজ এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কি কেউ নেই?
সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তর আজ দুর্নীতির বিষক্রিয়ায় ক্ষতবিক্ষত। দেশে সৎ মানুষের চেয়ে দুর্নীতিবাজদের প্রাধান্য বেশি। যাঁরা সততার সঙ্গে জীবনযাপন করেন, তাঁরা নানাভাবে দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে পরাস্ত হন। একজন দুর্নীতিবাজ বিত্তশালী সমাজে যে দম্ভের সঙ্গে চলেন, একজন সৎ ও সজ্জন মানুষ তা পারছেন না। একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে, অবৈধ উপায়ে দেশের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরও দেশের বেশ কিছু মুখচেনা দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে সরকারকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এত কিছু করার পরও এই ব্যক্তিরা দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে যে ধরনের সম্মান পান, একজন সারা জীবন সততার সঙ্গে কাজ করে দেশের জন্য অবদান রাখার পরও দুর্নীতিবাজদের তুলনায় ন্যায্য সম্মানটুকুও পান না।
বাংলাদেশে মূলত দুই ধরনের দুর্নীতি হয়ে থাকে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক, অন্যটি ব্যক্তিগত। বেশ কয়েক বছরে প্রকল্প ও মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নে অতিরিক্ত বাজেটের নামে বেশ কিছু দুর্নীতির ঘটনাকে যেভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, তাতে দুর্নীতি ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। ১০-১২ বছরে ব্যক্তিগত দুর্নীতির রেকর্ডও কম নয়। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ক্ষমতার বলয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের নামীদামি ব্যক্তিরা পিলে চমকানোর মতো দুর্নীতি করেও রেহাই পেয়ে গেছেন। যাঁদের কারসাজিতে শেয়ারবাজার ধ্বংস হয়েছে, যাঁরা লুটপাট করে ব্যাংকিং সেক্টরকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছেন, সরকারি আমলাসহ বিশেষ একটি গোষ্ঠী যেভাবে রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন; তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের নির্লিপ্ততা দুর্নীতিকে বরং উৎসাহিত করেছে। দেখা গেছে, এসব দুর্নীতির পেছনে কোনো না কোনো দায়িত্ববান ব্যক্তি কিংবা কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয় আছে।