গত বুধবার আফ্রিকার দেশ নাইজারে যে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে আবারও বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণের আভাস মিলেছে। বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় আটগুণ আয়তনে বড় পশ্চিম আফ্রিকার এ দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজুম দীর্ঘকালের একজন রাজনীতিবিদ। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহামুদু ইসোফুর শুধু ঘনিষ্ঠই ছিলেন না, তারা একসঙ্গে জেলও খেটেছেন। এক কথায় তিনি ছিলেন ইসোফুর দক্ষিণহস্ত। ইসোফু নাইজারের প্রেসিডেন্ট হলে বাজুম ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ফরেন অ্যাফেয়ার্স এবং ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দুই দফা নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইসোফু এর পর আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় বাজুম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ক্ষমতা ওই একই বলয়ের হাতে থাকে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতা ইত্যাদি অভিযোগে নাইজারের মিলিটারি, সিভিল প্রশাসন ও জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও তিনি ‘গণতান্ত্রিক সুষ্ঠু ভোটে’র মধ্য দিয়ে ২০২১ সালে নির্বাচিত হন। কিন্তু তিনি শপথ নেওয়ার আগেই একবার সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টা হয়। পরে আরও একটি ব্যর্থ চেষ্টা হয় গত মার্চে। এ দুই অভ্যুত্থানচেষ্টার জন্য বেশ কয়েকজনকে শাস্তিও দেওয়া হয়েছে দেশটিতে।
এত অসন্তোষের মধ্যেও কেন বাজুম সরকার টিকে ছিল? কারণ ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্র ইসোফু-বাজুমের সমর্থক হওয়ায় বাজুমের নির্বাচনটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ বলে স্বীকৃতি পায়। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ এ দেশটির ইসোফু-বাজুম সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ নিজেদের এলায়েন্স মনে করে। বাজুমকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ‘নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট’কে পূর্ণ সমর্থন দেবে বলে জানিয়েছে। অর্থাৎ তারা নাইজারের ক্যুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে মাঠপর্যায়ের ঘটনাবলি অন্য রকম দেখা গেছে।
বিশ্ব যে ভাগ হয়ে গেছে, এ কথা দরিদ্র নাইজারের জনগণের কাছেও এখন অজানা নয়। তাদেরই একটি অংশ নাইজারের সেনাবাহিনীর পক্ষে মিছিল বের করেছে রাশিয়ার পতাকা হাতে নিয়ে। সেøাগান দিয়েছে, লং লিভ পুতিন! তারা জানেন নাইজারের সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র মোহাম্মদ বাজুমের পক্ষে। ফলে তারা আশা করছেন, পুতিনের মার্সেনারি ফোর্স ওয়াগনার গ্রুপ প্রয়োজনে নাইজারে হস্তক্ষেপ করবে। ইতোমধ্যেই নাইজারের প্রতিবেশী দেশ মালিসহ সিরিয়া, লিবিয়া, সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মোজাম্বিক ও বিভিন্ন দেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ওয়াগনার গ্রুপ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই তারা কোথাও সরকারের পক্ষে এবং কোথাও বিদ্রোহী দলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। পশ্চিমারা অভিযোগ করে যে, এর প্রধান কারণ ব্যবসায়িক। তারা আফ্রিকার খনি ও বিভিন্ন ব্যবসায় হস্তক্ষেপ শুরু করেছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো- প্রতিটি দেশেই তারা পশ্চিমা; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যে পক্ষে, তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অর্থাৎ বিষয়টি শুধুই অর্থনৈতিক নয়। এটি পরিষ্কার যে, এশিয়ার মতোই পুতিন আফ্রিকার দেশগুলোতেও রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি করতে হাত বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে সরবে বা নীরবে ঢুকে পড়ছে চীন। সে কথায় পরে আসছি।