একাত্তরের যুদ্ধে দুটো স্বপ্নই ছিল। একদিকে ব্যক্তিগত দুঃস্বপ্ন, অপরদিকে সমষ্টিগত মুক্তির আশা। দুইয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না। সে অবস্থায় সেটা থাকার কথাও নয়; বরং ব্যক্তিগত দুঃস্বপ্ন সমষ্টিগত মুক্তির স্বপ্নকে সংহত ও দৃঢ় করেছে। আমরা বুঝে নিয়েছি, ব্যক্তির মুক্তি নিহিত রয়েছে সমষ্টির মুক্তির ভেতর। হত্যা, নিপীড়ন, ধর্ষণ, উচ্ছেদ, আতঙ্ক—সব মিলিয়ে এমন ব্যাপক দুঃসময় বাঙালির জীবনে আগে কখনো এসেছে কি না, সন্দেহ। না, আসেনি। তবু ওই ভীষণ অন্ধকারও মুক্তির সমষ্টিগত আশাটিকে নির্বাপিত করে দিতে পারেনি; বরং অত্যাচার যত বেড়েছে, মানুষের মনোবল তত দৃঢ়তা পেয়েছে। অস্পষ্টভাবে হলেও মানুষ এমন একটি সমাজ গড়ে তুলবে বলে আশা করেছে, যেখানে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা ঘটবে।
হানাদারেরা পরাজিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা বাধ্য হয়েছে তাদের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আত্মসমর্পণে। অপ্রত্যাশিত এই জন্য যে তাদের তো কোনো কিছুর অভাব ছিল না। অস্ত্র প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ, সরবরাহ, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর অকুণ্ঠ সমর্থন, যা ইচ্ছা তা করার অবাধ স্বাধীনতা—সবকিছুই পর্যাপ্ত পরিমাণেই পেয়েছে। তাহলে হারল কেন? হারল কার কাছে? হারল সমষ্টিগত স্বপ্নের কাছে। যত আঘাত করেছে, ততই তারা টের পেয়েছে ওই স্বপ্ন শক্তিশালী ও অপরাজেয় হয়ে উঠছে। হারল এই স্বপ্নের কাছেই। বাইরে তারা আত্মসমর্পণ করেছে ভারতীয় ও বাংলাদেশি যৌথবাহিনীর কাছে, কিন্তু ভেতরে তাদের আত্মসমর্পণ বাঙালির সমষ্টিগত মুক্তির যে স্বপ্ন, তার কাছেই।
মুক্তিযুদ্ধের জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। প্রশিক্ষণ তো ছিলই না; অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ–অভাব ছিল সবকিছুরই। যুদ্ধ যে করতে হবে, এ ধারণাটিও ছিল অনুপস্থিত। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্রোতের মতো মানুষ এসেছে যোগ দিতে, এসেছে কৃষক, শ্রমিক, সেনাবাহিনীর সদস্য, ইপিআর, পুলিশ, ছাত্র, নারী—কে আসেনি? এসেছে স্বপ্নের ডাকে, এসেছে দুঃস্বপ্নের দ্বারা তাড়িত হয়ে।
কিন্তু জয়ের পরেই সূত্রপাত ঘটল আমাদের ঐতিহাসিক পরাজয়ের। অন্য কারও কাছে নয়, পরাজয় ঘটল আমাদেরই ব্যক্তিগত স্বপ্নগুলোর কাছে। হানাদারেরা যা পারেনি, না পেরে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেছে, আমরা তা করলাম। আমরা সমষ্টিগত স্বপ্নটাকে ভেঙে খান খান করে দিলাম ব্যক্তিগত স্বপ্নগুলোর আঘাতে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধিকেই মনে করা হলো মুক্তির পথ। লোভ, লালসা, দখলদারি উগ্র হয়ে উঠল। বিদেশি হানাদারদের হাঁকিয়ে দিয়ে আমরা নিজেরাই হানাদার হয়ে উঠলাম। লুণ্ঠন, ছিনতাই, ভেজাল, ঘুষ, চোরাচালান, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট সংগ্রহ, পরিত্যক্ত এবং সামাজিক সম্পত্তিকে ব্যক্তিগত করা, জাতীয়করণের নামে কলকারখানা দখলে নেওয়া, পরীক্ষায় নকল, চাকরিতে অবৈধ উন্নতি, সম্পদ পাচার—কোনটা বাদ রইল? বাঙালি বাঙালির সঙ্গে এমন ব্যাপক শত্রুতা আর কখনো করেনি।