রায়মঙ্গল আর কালিন্দির মোহনায় তারা তখন কী একটা ব্যাপার নিয়ে যেন শলাপরামর্শ করছিল। সমুদ্রের পানি উত্তাল। আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস বার্তা আজকাল তাদের শোনা লাগে না। দুই নদীর মোহনা দুদেশের সীমান্ত বাংলাদেশ ও ভারতের। এখান থেকে ঢাকা-দিল্লির দূরত্ব অনেক।
কিন্তু সোবহান আর নরেন ব্যাপারটা দেখে অন্যভাবে। সোবহানের বাড়ি বাংলাদেশের শ্যামনগরের কালিঞ্চেতে আর নরেনের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের শমসেরনগরের কাটাখালিতে। তাদের ট্রলারে বাংলাদেশের পতাকাও আছে আর আছে ভারতের পতাকা। এ রকম রাখার কারণ তারা এমন জলসীমানায় মাছের সন্ধানে ফিরে সেখানে মাছেরা আন্তর্জাতিক, তাদের পাসপোর্ট, ভিসা চেক করার মতো বোকামির বিষয় আর নেই। একই নদীর দুটি ধারা গঙ্গা-যমুনা যেমন, তেমন সোবহান-নরেনের পেশার মধ্যে নেই ব্যবধান।
এখানে ভারতীয় রুপি আর বাংলাদেশের টাকার কোনো পার্থক্য প্রযোজ্য নয়। এখানে যেমনটি দুদেশের জলসীমানা থেকে ধরা সমস্ত মাছ মনে দুঃখ পাবে যদি তাদের ন্যাশনালিটি নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে। সুন্দরবন, তা বাংলাদেশ ভাগের হোক আর ভারতের ভাগে হোক বন তো সবার। সুন্দরবন সব বাঘ, বানর, কুমির, পশু-পাখি, মাছ, শামুক, শালিকের। ইদানীং সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গাছের আগামরা যে রোগের প্রাদুর্ভাব তা তো উভয় দেশের গাছ সম্প্রদায়ের জন্য দুঃসংবাদ। গাছদের প্রাণ আছে এটা তো জগদীশ চন্দ্র বসু বলে গিয়েছেন। সোবহান প্রতিদিন সকালে কোরআনের ৫৫ নম্বর সুরা আর রাহমান তেলাওয়াত করে; সেখানে ৬ নম্বর আয়াতে আছে ‘নক্ষত্রমালা ও বৃক্ষরাজি সৃষ্টিকর্তাকে সেজদা করে’।
নরেন আর সোবহান দুজনেরই দুঃখ সুন্দরবনের গাছ-গাছালি মহামারীর শিকার, যেন দিন দিন বন ছোট হয়ে যাচ্ছে, আগামরা রোগে মারা যাচ্ছে অনেক গাছ। বড় বড় ঘূর্ণিঝড়ে যে গাছ পড়ে যায় তার জায়গায় নতুন গাছ লাগানোর কোনো উদ্যোগ যেমন দেখা যায় না তেমনি পচামরা গাছগুলো সারানোরও কোনো খবর নেই। নরেন জানে তাদের দেশে সুন্দরবনের কাছে বড় শিল্পকারখানা এমনকি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নিষেধাজ্ঞা আছে তাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের। অথচ সোবহানের দেশে সুন্দরবনের কাছে শিল্পকারখানা এমনকি একটি বৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানো হয়েছে তাও দুদেশের যৌথ উদ্যোগে।