আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্য এক পণ্য নির্ভর; ৮২ শতাংশেরও বেশি রপ্তানি আয় আসে শুধু তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। এই অবস্থা এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখার মতো ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন সহযোগীরা দেশের রপ্তানি-ঝুড়ির পণ্য-সম্ভারে বৈচিত্র্য আনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে আসছেন। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় খাত হিসেবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি-ঝুড়ি বৈচিত্র্যকরণে নিতে পারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। বিশ্বে চামড়া আহরণযোগ্য মোট পশুসম্পদের মধ্যে ২ শতাংশের আবাসভূমি হলো বাংলাদেশে। এখানকার চামড়ার গুণগত মানও খুব ভালো; আন্তর্জাতিক বাজারে এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সরকারও এক্ষেত্রে সহায়ক নীতিমালা গ্রহণ করেছে। ফলে চামড়ার বৈশ্বিক চাহিদার অন্তত এক শতাংশ এদেশ সহজেই মেটাতে পারে। তাছাড়া, দেশে রয়েছে পর্যাপ্ত সস্তা শ্রম। চামড়ার প্রাচুর্যে মাঝে মধ্যে, বিশেষ করে কোরবানির ঈদের সময় দাম এত কমে যায় যে, অনেকে সেগুলো বিক্রি করার পরিবর্তে যেখানে-সেখানে ফেলে দিয়ে পরিত্রাণ লাভ করেন। সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে পারলে দেশে যেমন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেতে পারে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথও প্রশস্ত হতে পারে। তবে এ পথে বাধা-বিপত্তি বিস্তর।
দেশে চামড়া শিল্পের মধ্যে ২২০টার মতো ট্যানারি, ৩,৫০০টার মতো এমএসএমই (Micro, Small & Medium Enterprises) এবং ৯০টার মতো বৃহৎ কারখানা রয়েছে। আরও রয়েছে প্রায় ২,৫০০টা পাদুকা প্রস্তুতকারক ইউনিট। বছরে এগুলোর মাধ্যমে উৎপাদিত হয় মোট ৩৫০ মিলিয়ন বর্গফুট ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া। স্থানীয় চাহিদার পরিমাণ মাত্র ২০ শতাংশের মতো; বাকিটা রপ্তানি করা হয়। কিন্তু তৈরি পোশাকের মতো বাংলাদেশ ইউরোপ ও আমেরিকার সমৃদ্ধ বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে পারে না; ব্রান্ড মার্কেটের জন্য তার পদযাত্রা নিষিদ্ধ। কারণ, দেশে চামড়া শিল্পে রয়েছে কমপ্লায়েন্সের বড় ঘাটতি। চামড়া থেকে অনেক দূষণযুক্ত বর্জ্য নিঃসরিত হয় এবং চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে অনেক রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এগুলো সঠিকভাবে পরিশোধন করার ব্যবস্থা না নেওয়া হলে তা মানব, জীব ও উদ্ভিজের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত এই কমপ্লায়েন্স ছাড়া আরও রয়েছে শ্রমিকের কর্মপরিবেশ, মজুরি, কর্মঘণ্টা, শ্রম অধিকার সংক্রান্ত কমপ্লায়েন্সের ঘাটতি। ফলে প্রায় অর্ধেক মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে চীনের বাজারে। চীন সেটা পুনর্ব্যবহার অন্তে রপ্তানি করে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে। চীনের সঙ্গে মার্কিনিদের বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ায় চীনের চামড়া আমদানি কমে যায়। ফলে এখন দেশে চামড়া গড়াগড়ি যাচ্ছে। বিগত বছর প্রায় ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়ে যায় বলে খবর বেরিয়েছে।
উন্নত বিশ্ব আজ পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত ও নিরাপত্তাজনিত মান অনুসরণ করা নিয়ে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি উচ্চকিত। টেকসই উন্নয়নের জন্য আমরাও এক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না। কাজেই পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা গড়ার মাধ্যমেই অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাতে সাফল্য এলেও চামড়া খাত যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই রয়ে গেছে। আয় বাড়াতে হলে পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা গড়ার কোনো বিকল্প নেই।
সরকার অবশ্য এই খাতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত মান অর্জনের লক্ষ্যে হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্প সাভারে স্থানান্তরের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সেখানে একটা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (CETP) স্থাপনের পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও আন্তরিকতা নিয়ে এন্তার প্রশ্ন। কারণ, স্থানান্তর কাজে সময় লাগে ১৪ বছর, আর শোধনাগার নির্মাণে সময় ক্ষেপণ হয় ১১ বছর। এখন বলা যাচ্ছে যে, শোধনাগারের দৈনিক পরিশোধন ক্ষমতা ২৫,০০০ ঘন মিটার, আবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, এটার প্রকৃত সক্ষমতা ১৪ হাজার ঘন মিটার। কিন্তু সেখানে উৎপন্ন হচ্ছে প্রতিদিন ৪০,০০০ ঘন মিটার বর্জ্য। প্রয়োজনের তুলনায় এর পরিশোধন ক্ষমতা অনেক কম। তার চেয়েও বড় কথা পরিবেশবান্ধব চামড়া দিয়ে টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে ২০০৫ সালে গঠিত অলাভজনক বহুজাতিক সংগঠন এলডাব্লিউজি (Leather Working Group) এর কিছু কর্মকর্তা ইতিমধ্যে এই শোধনাগার পরিদর্শন করে এটাকে অকার্যকর বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। উন্নত দেশ ও ব্রান্ড মার্কেটগুলোতে প্রবেশাধিকারের জন্য এই সংস্থার সার্টিফিকেশন অপরিহার্য। তারা এই সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কারখানা থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ক্রয় করে থাকে। ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ১,০০০ এরও বেশি কারখানা এই সংস্থার সনদপ্রাপ্ত হয়েছে। ১৭টা সনদধারী কারখানা নিয়ে ভিয়েতনামের আজ চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ২০ বিলিয়ন ডলার। আর অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৩টি সার্টিফিকেট নিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় মাত্র ১.২৫ বিলিয়ন ডলার (২০২১-২২)। অনেকে মনে করেন যে, দেশে যদি ৩০ থেকে ৪০টা সনদধারী কারখানা থাকত, তাহলে চিত্র ভিন্ন হতো।
চামড়া খাতে আরও অনেক সমস্যা বিরাজমান। তবে আর দুই তিনটা সমস্যার কথা উল্লেখ করব। এ শিল্পের সঙ্গে অসংখ্য ক্ষুদ্র কলকারখানা জড়িত। পুঁজির অভাবে তারা প্রয়োজনীয় দামি মেশিনারি সংগ্রহ করতে অপারগ। এই কারণে এই শিল্পের চক্রনাভিগুলোতে (Hub) কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেওয়া হলে ছোট ছোট কারখানার মালিকরাও পণ্য উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হতে পারবেন।