শৈশবে একটা প্রশ্ন আমায় প্রায়ই তাড়া করতো। যে দেশটি জিতে নেয় অলিম্পিকের অধিকাংশ সোনা, প্রতিবছর নোবেলের বেশিরভাগ পদক শোভা পায় যার ক্রোড়ে, যার রয়েছে এমন সব অতিকায় কোম্পানি যাদের একেকটির আয় গোটা বাংলাদেশের জিডিপিকে ছাড়িয়ে যায়, সেই দেশটিকে কেন এক গোলার্ধ পেরিয়ে ছুটে আসতে হয় বাংলাদেশে? ভিড় জমাতে হয় জীর্ণ-শীর্ণ বাংলাদেশী গার্মেন্টসগুলোতে? আশ্চর্য হলো, প্রশ্নটা থেকে এই পরিণত বয়সেও মুক্তি মেলেনি আমার, সুযোগ পেলেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমায় শৈশবের মতো!
যখন বাংলাদেশের রানা প্লাজায় সহস্রাধিক লোক জীবন দিয়ে পৃথিবীর সব থেকে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল দুর্ঘটনাগুলোর একটির জন্ম দেয়, তখন একটি আমেরিকান আর্টিকেল বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছিল, যার শিরোনাম ছিল–“বাংলাদেশ ফ্যাক্টরি কলাপস: হু রিয়েলি পেইস ফর আউয়ার চিপ ক্লোথস?”
এটা সেই সময় যখন বাংলাদেশের টি শার্ট আর জিনসের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছিল আমেরিকান সমাজে। কী ছিল বাংলাদেশে তৈরি পোশাকে? এগুলো কি সেই ঢাকাই মসলিনের মতো ফিনফিনে ছিল যে একটি দিয়াশলাই বাকসে ৫০ মিটার কাপড় এঁটে দেয়া যায়, আর পশ্চিমা তরুণ-তরুণীরা সেই দিয়াশলাই খেলার লোভেই পা বাড়ায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ শপিং মলে? মজার ব্যাপার হলো, গায়ে-গতরে মসলিন যুগের মতো পাতলা না হলেও বাংলাদেশের এই জমানার পোশাকগুলো কিন্তু দামের দিক থেকে ভয়ানক পাতলা। প্রায় এক গোলার্ধ দূরের একটি দেশের মানুষের পোকামাকড়ের মত ঘরবসতি, তাদের সস্তা শ্রম, আর সস্তা সব নিয়মকানুন যাকে অল্প মূল্যেই বদলে দেয়া যায়–সেই গল্পগাঁথা, যা আগে ছিল প্রদীপের আড়ালেই, তা-ই উন্মোচন করে দেখিয়েছিল রিপোর্টটি! কিন্তু যে মানুষগুলো ছিল কারিগর, তাদের যে কালের বিবর্তনে শ্রমিক বানিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে রিপোর্টটি ছিল একেবারেই নীরব।
বাংলাদেশ গর্ব করে পৃথিবীর নাম্বার টু গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার। ইউরোপে প্রতি তিনজনের একজনের গায়ে দেখা যায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ টি শার্ট। আমেরিকায় প্রতি পাঁচজনের একজনকে দেখা যায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ জিন্স পরতে। ১৯৭৮ সালে ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানে ১৩ মিলিয়ন ফ্রাংকের একটি ক্ষুদে চালান দিয়ে যার যাত্রা শুরু, সে-ই আজ ২৮.১৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি নিয়ে অভ্যন্তরীণ রপ্তানি বাজারের ৮২ শতাংশ ও বৈশ্বিক তৈরি পোশাক বাজারের ৬.৪ শতাংশ দখল করে বসে আছে। সর্বসাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি-প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষ দেশটির নাম হল বাংলাদেশ। মৌলিক ও নিম্ন-মধ্য ক্যাটাগরির পোশাক উৎপাদন যার দৈনন্দিন ব্যবহার এমনকি যুদ্ধও ঠেকাতে পারেনি–তা গড়ে দিয়েছে এমন বুনিয়াদ বাংলাদেশের জন্য। অর্থনীতির দিকপাল ও নীতিনির্ধারকরা এই শিল্পেই দেখছেন বাংলার প্রাণভোমরা, আর তাই সেট করে নিয়েছেন ৫০বিলিয়ন ডলারের একটি অতিকায় রপ্তানি টার্গেট অদূর ভবিষ্যতের জন্য।