ময়মনসিংহের নান্দাইলের চণ্ডীপাশা ইউনিয়নের গ্রাম ধুরুয়াতে শিশু নুসরাতের নানাবাড়ি। স্বজনদের সঙ্গে ৩–৪ বছরের এই ফুটফুটে শিশু বেড়াতে গিয়েছিল। বোধ করি, সেখানে তার বয়সী মামাতো–খালাতো ভাইবোনদের সঙ্গে আনন্দে মেতেছিল সে। সেই আনন্দ কেবল খেলাধুলায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের সঙ্গে দেশের মৌসুমি ফল লিচু খাচ্ছিল সে। একপর্যায়ে লিচুর একটা বিচি তার গলায় আটকে যায়। সবাই বলছেন, তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কত দ্রুত?
চিকিৎসকেরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে ৭–১২ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা শুরু না করলে রোগীকে বাঁচানো মুশকিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ রকম পরিস্থিতিতে অভিভাবকেরা ঘাবড়ে গিয়ে নানা ধরনের ভুল করে বিপদের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। যেমনটা দেখা গেছে রংপুরের বদরগঞ্জে।
উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ বাওচণ্ডী খিয়ারপাড়ায় বাক্প্রতিবন্ধী শিশু হজরত আলীর (৬) গলায় লিচুর বিচি আটকে যায়। এ সময় তার মা কোহিনূর বেগম শিশুটির গলায় আঙুল ঢুকিয়ে লিচুর বিচি বের করার চেষ্টা করেন। এতে শিশুর মুখ দিয়ে রক্ত বের হলে সবাই ঘাবড়ে গিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়। হজরত আলী আর ফিরে আসেনি।
গত ৯ মে নুসরতকে দিয়ে শুরু হলেও কয়েক সপ্তাহের মধ্যে লিচুর বিচি গলায় আটকে মারা যায় ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের জুনাইদ (৩), পঞ্চগড়ের অটোয়ারীর রায়হান (৪), রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার সাগরপাড়ার মাহমুদ (দেড় বছর), কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার শিলমুড়ী দক্ষিণ ইউনিয়নের গ্রাম জোয়াগের হোসাইন (১ বছর), চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মোহাম্মদ আদিল (৬ মাস) ও হাটহাজারীর শিশু সফোয়ান (দেড় বছর)।
গণমাধ্যমের বরাতে লিচুর বিচি খেয়ে মারা গেছে, এমন আট শিশুর তথ্য পাওয়া গেছে। প্রকৃত সংখ্যা আসলে কত, সেটা জানা যায়নি। মৃত এসব শিশুর মধ্যে বদরগঞ্জের বাক্প্রতিবন্ধী হজরত আলী ছাড়া অন্য সবার বয়স ৫ বছরের নিচে। আমাদের জন্য স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, নানা রোগ প্রতিরোধে শিশু বয়সে প্রতিষেধক টিকা নেওয়ার সুবাদে পাঁচ বছরের কম বয়সী কম শিশুই এখন অসুখ–বিসুখে মারা যায়। তবে আশঙ্কার বিষয়, নানা দুর্ঘটনা আর আমাদের অবহেলায় শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে।
এখনো বয়স মাত্র ৬–৭ মাস, এমন শিশুদের তো লিচু খাওয়ার বয়স হয়নি। অবাক করা বিষয়, এসব শিশুর নামও এবার মৃত্যুর তালিকায় আসছে। গত ৩০ মে সন্ধ্যায় বাড়ির সবাই মাগরিবের নামাজে ব্যস্ত। ঠিক এমন সময় চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ৬ মাসের শিশু আদিল একটি লিচুর বিচি কুড়িয়ে পেয়ে মুখে দেয়। সেটি তার গলায় আটকে যায়। এরপর শ্বাসকষ্টে ছটফট করতে থাকে সে। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে বাঁচানো গেল না শিশুটিকে। চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা ছাড়া কিছুই করতে পারলেন না।
শিশু আদিলের নানার বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার শাহনগর গ্রামের মাইজপাড়ায়। এ ঘটনার আগে গত ২১ মে হাটহাজারীতে মারা যায় দেড় বছরের শিশু সফোয়ান। তারও গলায় লিচুর বিচি আটকে যায়।
তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। পরিবারের সদস্যরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে সেদিন লিচু খেলে শিশু সফোয়ান কুড়িয়ে পাওয়া লিচুর বিচি সবার অজান্তে মুখে দিলে তার গলায় আটকে যায়। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাটহাজারী সদরের একটি প্রাইভেট হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা আদিলের মতো তাকেও মৃত ঘোষণা করেন।
এত বছরের একটা মৌসুমের কথা। শিশুরা যে শুধু গলায় লিচুর বিচি আটকে মারা যাচ্ছে, তা নয়। নানা সময় দেখা যায়, চকলেট, মার্বেল, ছোটখাটো খেলনা, ধাতব মুদ্রা, রসগোল্লাজাতীয় মিষ্টি ইত্যাদি গলায় আটকে ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে শিশুরা।