ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্ব। তৎকালীন ভারতে একদিকে প্রাচীনপন্থিদের ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি মাথাচাড়া দিয়েছিল; অন্যদিকে পাশ্চাত্যের ভাবধারার নব্য শিক্ষিত উগ্রপন্থিদের ধর্মবিমুখতা সমাজ জীবনে ডেকে এনেছিল মহা বিপর্যয়। অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে জর্জরিত মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধ ভুলতে বসেছিল। এমনই এক যুগসন্ধিক্ষণে প্রেমের ঠাকুর পতিত উদ্ধারকারী শ্রী শ্রী প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর আজ থেকে ১৫৩ বছর আগে এ ধরাধামে আবির্ভূত হন।
ফরিদপুর শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন মহানাম সম্প্রদায় ও ফরিদপুরবাসী প্রভু সুন্দরের ১৫৩তম আবির্ভাব উৎসবের আয়োজন করেছে। এ উৎসব ৯ দিনব্যাপী উদযাপিত হচ্ছে; বাংলা ১৪ বৈশাখ, ১৪৩০ (২৮ এপ্রিল, ২০২৩) থেকে বাংলা ২২ বৈশাখ ১৪৩০ (৬ মে ২০২৩) পর্যন্ত। পবিত্র সীতা নবমী তিথিতে মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত ডাহাপাড়া গ্রামে প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর বঙ্গাব্দ ১২৭৮ সনের ১৬ বৈশাখ (১৮৭১ সালের ২৮ এপ্রিল) সীতা নবমী তিথিতে আবির্ভূত হন। তাঁর মাতা বামাদেবী, পিতা দীননাথ ন্যায়রত্ন। ছোটবেলায় প্রভু সুন্দরের মাতৃবিয়োগ হয়। পিতা দীননাথ ন্যায়রত্ন মুর্শিদাবাদ থেকে প্রভু সুন্দরকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদপুর চলে আসেন। শহরের ব্রাহ্মণকান্দায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ব্রাহ্মণকান্দার অদূরেই গোয়ালচামট শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন অবস্থিত। প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের লীলাকাল অতি সংক্ষিপ্ত। মাত্র ৫০ বছর। ১৩২৮ সনের আশ্বিন মাসের ১ তারিখে প্রভু সুন্দর লীলা সংবরণ করেন। অতঃপর মহানাম সম্প্রদায় প্রভুর কৃপা নির্দেশে প্রভুর মহাপ্রয়াণের পর থেকে আজ প্রায় শতাব্দীকালের ঊর্ধ্বে সেই ভুবন মঙ্গল কীর্তনযজ্ঞ অহোরাত্র বিরামহীনভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর একাধারে ছিলেন মহামানব ও অবতার পুরুষ। অন্যদিকে ছিলেন মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারক। প্রভু সুন্দরের আবির্ভাবের আগে প্রেমের ঠাকুর শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু আবির্ভূত হন। প্রেম ও ভালোবাসার বেদিমূলে মানুষকে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রেমের বন্যায় সবাইকে অবগাহন করিয়ে কাছে টেনে নেন। কিন্তু কালের প্রভাবে মানুষ জড়বাদ ও ভোগবাদিতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। মানুষ ধর্মাচরণ ভুলে যায়। মহাপ্রভুর তিরোধানের পৌনে তিনশ বছর পর এ দেশে ইংরেজ শাসন শুরু হয়। ইংরেজি ভাষায় নব্য শিক্ষিতরা দেশবাসীর ধর্মবোধকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে। গোপী প্রেমকে তারা নর-নারীর কামলীলার রূপায়ণ বলে অবহেলা করতে থাকে। সমাজ জীবনে দেখা যায় হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি ও অশান্তি। ফরিদপুর শহরের উপকণ্ঠ ও শহরতলিতে নিম্নবর্ণের বুনা, বাগদি, সাঁওতাল বসবাস করত। বুনা শ্রেণির অধিকাংশ লোকই ছিল অশিক্ষিত ও কুসংস্কারপূর্ণ। মদ্যপান, গাঁজা সেবন প্রভৃতি ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের পাদ্রি সাহেবরা বুনা জাতির এ দুর্বলতার সুযোগে তাদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেন।