এটা ইতিহাস যে বাংলাদেশের ২০ ও ২১তম রাষ্ট্রপ্রতি একই ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি সর্বজনপ্রিয় একজন অকপট রাষ্ট্রপতি। অকপটে কথা বলতে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত ও পারদর্শী। তাঁর এই অকপটে কথা বলার অভ্যস্ততা সহজ-সরল আচরণের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেত, যা তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল অবলীলায়। ক্ষমতার শেষ দিনটি পর্যন্ত তাঁর সেই জনপ্রিয়তা অটুট থেকে গেছে। তাঁর এই জনপ্রিয়তা কেবল তাঁর রাজনৈতিক দলের ভেতরেই নয়, বরং দল-মতনির্বিশেষে সাধারণ মানুষ, তরুণসমাজ—সবার কাছেই তিনি শ্রদ্ধার জায়গাটুকু অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সহজ করে কথা বলা একটা বড় গুণ, যা মানুষ সহজে রপ্ত করতে পারে না। বরং এর জন্য তাঁকে অসাধারণ গুণের অধিকারী হতে হয়। সাধারণ হয়ে চলার জন্য যে অসাধারণ গুণের অধিকারী হওয়া, সেটা হয়েছিলেন সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
সম্ভবত সে কারণে খুব সহজে আর দশজন থেকে তাঁকে আলাদা করা যায়। তাঁর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। ১০ বছর ৪৮ দিন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত থাকার পর ২৩ এপ্রিল হয়ে গেল বঙ্গভবন থেকে তাঁর রাজসিক বিদায় সংবর্ধনা। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে কোনো রাষ্ট্রপতির এমন রাজসিক বিদায় সংবর্ধনা এই প্রথম। বঙ্গভবনের ইতিহাসে এ এক বিরল দৃশ্য। এই সৌভাগ্য যেমন সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতির, তেমন সৌভাগ্য বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের। সেই সঙ্গে এও না বললে নয় যে, একই দিনে নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের শপথ গ্রহণ ও বঙ্গভবনে প্রবেশের দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছে বাংলাদেশের মানুষসহ গোটা বিশ্ব। গণতন্ত্রচর্চার এ এক বিরল দৃশ্য!
আবদুল হামিদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। ষাটের দশকে তিনি ছিলেন কিশোরগঞ্জ ছাত্রলীগের সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ অনুসারী। ছাত্ররাজনীতি দিয়েই তাঁর পথচলা। তাঁর জীবনের চারটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রথমত, তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, দ্বিতীয়ত, আইনজীবী, তৃতীয়ত, একজন সফল স্পিকার এবং চতুর্থত একজন সফল রাষ্ট্রপতি। এক দশক ধরে তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং সেটা সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে। জীবনের কোনো অধ্যায় নিয়ে তেমন বিতর্ক বা সমালোচনা ছিল না বলেই অনেকের বিশ্বাস। রাষ্ট্রের অভিভাবকত্ব তাঁর কাছে মুখ্য ছিল। কথায়, প্রতিক্রিয়ায় তিনি সব সময় সেটাই বজায় রেখেছেন। যখন তিনি স্পিকার হলেন, তখন তাঁকে কখনোই মনে হয়নি তিনি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কেউ কিংবা তিনি দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত।
একই কথা প্রযোজ্য রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও। তিনি চেষ্টা করেছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অভিভাবক হয়ে থাকার। তাঁর আচরণে রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা কখনো তৈরি হয়নি। তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের অনিয়ম, ভুলভ্রান্তি নিয়ে অকপটে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, সংশোধন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকই তাঁর দায়িত্বে থাকার মর্যাদাটুকু পেয়েছিল।