ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বেশ কয়েক বছর ধরেই অসুস্থ। কিডনি-জটিলতায় ভুগছিলেন। তার ওপর কোভিড ও নিউমোনিয়ার ছোবল। চিকিৎসাসেবার সার্বক্ষণিক তদারকির সুবিধার্থে তিনি বাসায় না থেকে তাঁর নিজের গড়া হাসপাতালেই থাকতেন। ডায়ালাইসিস করাতেন সপ্তাহে তিন দিন।
সেখান থেকেই তিনি জুমে টক শো করতেন, আবার নানা সামাজিক কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। কয়েক দিন আগে হঠাৎ করেই শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। শেষ দিকে ছিলেন লাইফ সাপোর্টে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁর বাসায় ফোন দিয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চেয়েছিলাম। আমাকে বলা হলো, তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল। একটু নড়াচড়া করেছেন। তবে জ্ঞান ফেরেনি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টেলিভিশন স্ক্রলে জানা গেল, তিনি আর নেই। স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাঁদিয়ে চলে গেছেন অনন্তধামে। এক বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি হলো।
দেশে তো অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তিনি ছিলেন অনন্য। বাড়ি, গাড়ি, তেলের পাম্প, ব্যাংকের লাইসেন্স, আর ভাতার পেছনে দৌড়াননি। সব সময় ছিলেন সৃজনশীল। তাঁর কীর্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনকল্যাণমুখী ছিল গরিবের হাসপাতাল হিসেবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং ওষুধনীতি তৈরিতে অনুঘটকের ভূমিকা নেওয়া। এ দেশের পাঁচ দশকের ইতিহাসে এই দুটোকে রীতিমতো বিপ্লব বলা যেতে পারে।
তৃতীয় দুনিয়ার অনেক দেশে, বিশেষ করে মেক্সিকোর গ্রামে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বোস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহযোগী অধ্যাপক ডেভিড বি ওয়ার্নার স্প্যানিশ ভাষায় লিখেছিলেন ডনডে হে ডক্টর। ১৯৭০ সালে এটি প্রকাশিত হয়। পরে দুই সহলেখক ক্যারল থুমান আর জেন ম্যাক্সওয়েলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এর ইংরেজি করলেন হয়্যার দেয়ার ইজ নো ডক্টর: আ ভিলেজ হেলথকেয়ার হ্যান্ডবুক। এই চিন্তা আর অভিজ্ঞতা থেকেই সদ্য যুদ্ধফেরত জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঢাকার বাইরে ধামরাইয়ের গ্রামে প্রতিষ্ঠা করলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। গ্রামের বেকার তরুণ আর হাতুড়ে ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করলেন একঝাঁক প্যারামেডিক। তাঁরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেবেন। গুরুতর রোগ থাকলে রেফার করবেন কাছাকাছি হাসপাতালে। এই মডেলটি নিয়ে ব্র্যাকও কাজ করেছে। ব্র্যাকের প্যারামেডিকরা প্রশিক্ষণ নিয়েছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পরবর্তী ‘জিহাদ’ ছিল বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। প্রায় সব ওষুধই তখন আমদানি হতো। এখানে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হতো না বললেই চলে। তখন তাঁর স্লোগান ছিল, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’। অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলামসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে তিনি জাতীয় ওষুধনীতি তৈরির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বিদেশি কোম্পানিগুলো তখন গ্রাইপ ওয়াটার, ওয়াটার ব্যারিজ কম্পাউন্ড এবং নানা ধরনের কফ সিরাপ ও টনিকের ব্যবসা করে মানুষের পকেট কাটছে। এসবের অনেকগুলো ছিল অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর। রাষ্ট্রপতি এরশাদকে দিয়ে তিনি এটা জাতীয়ভাবে অনুমোদন করালেন।