ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। পত্রিকায় তার বড় বড় দাবিগুলো আমরা আর দেখব না। তার অসুখের খবরও আর আমরা কদিন পর পর দেখব না। তিনি দেশের কাছে একটা স্থায়ী স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবেন।
ডা. জাফরুল্লাহকে আমরা একেকজন একেকভাবে মনে রাখব, যেহেতু তার বহু পরিচয়। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আমার কাছে তার যে পরিচয় ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকবে, সেটা হলো ডা. জাফরুল্লাহ সদ্য ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশের নতুন পরিচিতির রূপরেখা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। যে বাংলাদেশের পরিচয় তিনি উন্মোচন করে দিয়ে গেছেন, সে বাংলাদেশ কোনো বাধা মানে না। সে বাংলাদেশ পুরোনোর কোনো আবরণে ঢাকা পড়তে নারাজ। সে বাংলাদেশ নিজের রাস্তা নিজের মতো করে বের করে নেওয়ার সন্ধানে ছুটতে জানে। তার আত্মবিশ্বাস নক্ষত্রছোঁয়া।
তরুণ জাফরুল্লাহ এককভাবে ছুটে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। কে কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, কী হিসাব মেলাচ্ছে, কী ব্যাখ্যা দিচ্ছে, কোনো কিছুর ধার ধারেননি তিনি। নিজেই নিজের ভূমিকা ঠিক করে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। রণাঙ্গনে ফিল্ড হাসপাতাল লাগবে? তাই হবে। কী আছে, কী নাই, তার হিসাবের অপেক্ষায় কিছুই আটকে থাকবে না। জাফরুল্লাহ বাধা মানতে জানেননি কখনো। তিনি তার পেশাকে অবলম্বন করে যাত্রা শুরু করেছেন, কিন্তু পেশার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি মোটেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র করেছেন, কিন্তু নিশ্চিত করেছেন রোজ ভোরে কেন্দ্রের সবাইকে নিয়ে খেতে চাষ করা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সবস্তরের সিকিউরিটির জন্য প্রহরী দিলেন নারীদের। কোনো পুরুষকে এ কাজে নেওয়া হয়নি। তার গাড়িতে সার্বক্ষণিক নারী ড্রাইভার। ঢাকা-সাভারসহ সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন তার নারী ড্রাইভার নিয়ে। সমালোচনা হচ্ছে? জাফরুল্লাহকে কোনো সমালোচনা কাবু করতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার খবর সংগ্রহ করেছি আগ্রহ নিয়ে। সবাইকে জানিয়েছি তার খবর। তিনি ছিলেন আমাদের আশার প্রতীক। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে আসলাম। আসার সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গঠিত বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি বিখ্যাত স্থপতি ডা. এফ আর খান একটা অবৈতনিক দায়িত্ব দিলেন। আমি তার বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করব। আমি সোৎসাহে রাজি হলাম। প্রথম কাজ করলাম ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে দেখা করে তার একটা প্রজেক্টে অর্থ সহায়তা দেওয়া।
সাভারে গেলাম। খালি মাঠে কয়েকটি তাঁবু নিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সমবয়সী অদ্ভুত এক যুবকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ। তার কাজের কোনো সীমা নেই। সেই থেকে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক। তারপর জাতীয় ওষুধ নীতি নিয়ে গভীরতর সম্পর্ক। তিনি আমাকে ওষুধ নীতি প্রণয়নের কমিটিতে নিলেন। সে এক অসম্ভব কাজ। জাফরুল্লাহর অসম্ভব সব স্বপ্ন। সব ওষুধ দেশে তৈরি করতে হবে। ইচ্ছা করলেই যেকোনো ওষুধ তৈরি করা যাবে না। ওষুধের দাম সরকার ঠিক করে দেবে। বিদেশি বিশাল ওষুধ কোম্পানি এবং তাদের দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সদ্য জন্মলাভ করা দরিদ্র এক দেশের মুখোমুখি সংঘাত। কিছুই মানেননি ডা. জাফরুল্লাহ। অবাক হয়েছি তার দৃঢ়তা এবং তথ্য-যুক্তির প্রয়োগে। তার কারণে ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ একটা নেতৃস্থানীয় শক্তিতে পরিণত হলো। এ কাজ করতে গিয়ে বহু বিপরীত শক্তির মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তাকে কাবু করতে পারেনি কেউ।