একটি ঘটনা খুব কাছের মানুষের সঙ্গে ঘটেছে। মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির রেজাল্ট বেরিয়েছে। কাছের সেই ছেলেটি চান্স পেয়েছে। সামনেই ভর্তির তারিখ। ভর্তির সময় মার্কশিটের মূল কপি নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বোর্ড এখন পর্যন্ত তা দেয়নি। ছেলেটি তার এক বন্ধুর কাছ থেকে জানল বোর্ডে আবেদন করার পদ্ধতি। আবেদন করে বসে আছে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এসএমএস আসার কথা। কিন্তু আসেনি। তখন সে তার বন্ধুকে আবার ফোন করে এবং জানতে পারে তার বন্ধুটি নিজে শিক্ষা বোর্ড অফিসে গিয়ে বিশেষ একটি রুমে এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে তিন হাজার টাকা হাতে দিয়ে তার মার্কশিট হাতে হাতে পেয়েছে। আমার এই আলোচ্য ছেলেটি একই কাজ করেছে এবং পেয়ে গেছে। মার্কশিট হাতে নিয়ে সে মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়েছে। বারবার বলছে, এ আমি কী করলাম! কেন করলাম! জীবনে এটাই তার প্রথম কাউকে ঘুষ দেওয়া।
উল্লেখ্য, ঘুষ নেওয়ার সময় ভদ্রলোক বলেছেন, এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। সুতরাং ‘এখানে তুমি পকেটে হাত দিয়ো না, বাইরে চলো।’ একটি বিশেষ জায়গায়, যেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই, নিয়ে গিয়ে তার কাছ থেকে টাকাটা নিয়েছেন।
কয়েক দিন আগে বগুড়ার একটি সরকারি গার্লস স্কুলে একজন অভিভাবক, যিনি নিম্ন আদালতের একজন বিচারক, অন্য একজন অভিভাবককে প্রকাশ্যে মাফ চাইতে বাধ্য করেছেন। ঘটনাটি সারা দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে।
এ সময়ে অন্য একটি ঘটনাও আলোচিত হয়েছে। স্যার না বলায় রংপুরের জেলা প্রশাসক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সঙ্গে অনভিপ্রেত আচরণ করেছেন।
স্যার বলা না-বলা নিয়ে ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং খবরের কাগজে আরও অনেক খবর ও বিশ্লেষণ বেরিয়েছে। কেউ কেউ স্যার না বলতে টেবিলে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রেখেছেন। কেউ এত বড় ঘটনার পরও স্যার না বলায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে অভিযোগ করেছেন। একজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব স্যার না বলে নাম ধরে ডাকা সমীচীন বলে মন্তব্য করেছেন। কেউ আবার নৈতিকতার যুক্তি তুলে সরকারি কর্মচারীদের পরামর্শ দিয়েছেন—সব নাগরিককে স্যার ডাকার। একজন মন্ত্রী বলেছেন, স্যার সম্বোধন করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই ইত্যাদি।
আমি কথা দিচ্ছি, আজকের লেখায় এই ঘটনাগুলোর আলোচনার পুনরাবৃত্তি করব না। কারণ, দুটি ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এখন তা অনেকটা বিরক্তির পর্যায়ে। যদিও আমার মতে, আলোচনাটা জারি থাকা ভালো। কেননা, এ ধরনের সমস্যা বা অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার উদ্ভব মাঝে মাঝেই হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। আলোচনা, সমালোচনা হয়ে একটি সিদ্ধান্তের জায়গায় পৌঁছালে সব পক্ষের জন্য যেমন স্বস্তির হবে, তেমনি জাতির জন্য সেটা কল্যাণকর হবে।
ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে পারিপার্শ্বিক কিছু অনুধাবন আমাদের প্রয়োজন। বিষয়গুলো ভিন্ন হলেও একটা জায়গায় বোধ হয় এগুলোর মধ্যে বেশ মিল আছে। সেটা হলো আত্মসম্মানবোধ। কারও প্রখর আবার কারও তা-ও নেই।
রংপুরের ডিসির ঘটনাটি যেভাবে আয়ত্তে এনেছেন, সেটা ভালো। তিনি জেন্ডার সেনসিটিভিটির কথা বলেছেন। সরল মনে তা গ্রহণ করা যেতেও পারে। যদি তা না-ও বলতেন, তবু স্যার সম্বোধন করা বা না করার বিষয়টি শুধু রংপুরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সরকারি কর্মচারীদের এটা মজ্জাগত হয়ে গেছে। এখান থেকে বের হতেই হবে। কেননা, স্যার সম্বোধন প্রভু ভৃত্যের মতো শোনায়। এটা হয়তো ঔপনিবেশিক আমলের প্রভাব।
সম্প্রতি আমি একটি ঘটনা লক্ষ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র প্রফেসর এবং সাবেক উপ-উপাচার্য একটি আলোচনায় ডিসি সাহেবকে ‘স্যার’ সম্বোধন করছেন (তিনি সবাইকে স্যার বলেন)। অপরপক্ষে ডিসি সাহেব সেই সিনিয়র প্রফেসরকে ‘প্রফেসর সাহেব’ বলেছেন। নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন যুক্তিসংগত, কেন একজন ডিসি বা এডিসি একজন চিফ ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি ব্যাংকের ডিজিএম, জিএম, কোনো হাসপাতালের প্রধান অথবা বিভাগীয় পর্যায়ের আধিকারিক, যিনি তাঁর চেয়ে পদে বড়, তাঁকে স্যার সম্বোধন করেন না (ব্যতিক্রম অবশ্য আছে)! বয়স, পদ, পেশা, ক্ষমতানির্বিশেষে সবাই সবাইকে স্যার সম্বোধন করলে বোধ হয় ‘স্যার’-এর অহংকার কমত।