আমরা আরেকটা ডিজিটাল ডিভাইডে

সমকাল জাকারিয়া স্বপন প্রকাশিত: ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০২:০০

দু’জন ভিআইপি খুন হবে! সানফ্রান্সিসকোর ফলসাম স্ট্রিটে রেভেন ক্লাবে একটা মারগারিটা নিয়ে কয়েক সিপ দিয়ে আরাম করে বসেছিল আরিমা। ওর বন্ধু একটু পরেই স্টেজে গান গাইবে। ঠিক এমন সময়ে মেসেজটা এসেছে।


বন্ধুদের নিয়ে লাইভ মিউজিক দেখা আর নিজেকে নিত্যদিনের কাজ থেকে দূরে রাখার ভালো উপায় হলো এখানে এসে কিছুটা সময় পার করা। ওর কাজের ধরনটাই এমন যে, সারাক্ষণই প্রস্তুত থাকতে হয়। আলাদা করে বিশ্রাম বলে কিছু নেই। তাই এ ধরনের মেসেজে অবাক না হয়ে উত্তর দিল, হাতে কতক্ষণ সময় আছে?


উত্তর এলো, ঠিক ৩৭ ঘণ্টা ২৩ মিনিট ১৭ সেকেন্ড।


লোকেশনটা দাও। মেসেজটা দিয়েই চশমার মোডটা পরিবর্তন করে দিল। পরক্ষণেই ওর চশমার স্ক্রিনে ভেসে উঠল ৭ হাজার ৬৭৩ মাইল দূরের একটি শহর, যার নাম ঢাকা। প্রিসাইজ জিপিএস লোকেশন। লাইভ দেখতে পাচ্ছে। ভরদুপুর; ট্রাফিক জ্যামে সবাই আটকে আছে। কিছুই নড়ছে না। ফুটপাতে মানুষ গিজগিজ করছে।


ক্লাব থেকে বের হয়ে নিজের গাড়িতে গিয়ে বসল আরিমা। কানে হেডফোন লাগিয়ে এবার কথা বলল, ওই লোকেশনে আমাদের রিসোর্স অ্যাভেলেবেল আছে?


সিস্টেম থেকে উত্তর এলো– পর্যাপ্ত। তুমি টেকওভার করো। ওরা তোমার নির্দেশে কাজে নেমে যাবে।


আচ্ছা। তোমার কাছে কি টার্গেটের বিস্তারিত আছে?


হুম্...।


কীভাবে অপারেশনটা হবে, বের করতে পেরেছো?


হ্যাঁ। ওটা নিশ্চিত হয়েই তোমাকে জানালাম। নইলে এই অসময়ে তোমাকে বিরক্ত করতাম না। আমরা জানি, তুমি তোমার বন্ধুর গানের অনুষ্ঠানে ক্লাবে আছো।


ঠিক আছে, বিস্তারিত বলো আমাকে।


ভিআইপি দু’জন এক গাড়িতেই থাকবে। প্রথমে একটা ড্রোন গাড়ির সামনে চলে আসবে। ড্রাইভারের সামনে দিয়েই উড়তে থাকবে। ওটা হলো ড্রাইভারকে বিভ্রান্ত করার টেকনিক। ততক্ষণে আরও দুটো ড্রোন গাড়ির দুই পাশে চলে যাবে। ওদের কাছে আলট্রা সাউন্ড জেনারেটর আছে। সেটা দিয়ে গাড়ির গ্লাস ভেঙে দেবে। তারপর বিশাক্ত সুঁই ছুড়ে মারবে ওদের শরীরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শেষ। ড্রোনগুলো উড়ে চলে যাবে। পুরোটাই রিমোট কন্ট্রোল।


ওই শহরের কতটুকু আমাদের কাভারেজে আছে?


সিস্টেম বলল, ঢাকা শহরের পুরোটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে।


আরিমা একটি কমান্ড দিয়ে নেটওয়ার্কটি দেখে নিল। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ ট্রাফিক লাইট এবং রাস্তার বিদ্যুতের টাওয়ারে সেন্সর বসানো। ৯৯.৯৯% ফাংশনাল। মানুষ যখন ওই এলাকা ক্রস করে, তখন তার মোবাইলের সকল তথ্য, ছবি, ভিডিও সবকিছু সঙ্গে সঙ্গেই ওগুলোর মাধ্যমে টেনে নেয় সিস্টেম। ওই শহরে মানুষ ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকে বেশিরভাগ সময়। তাতে কাজটা আরও সহজ হয়েছে।


আরিমা পরের অ্যাকশনের জন্য ডাটা নিতে শুরু করল। ভিআইপি দু’জন কারা, তাদের বিস্তারিত; মোটিভ কী; যারা অপারেশন চালাচ্ছে তাদের সম্পর্কে তথ্য; কীভাবে এটাকে ফেরানো যাবে তার সম্ভাব্য পদ্ধতি সবই সিস্টেম তৈরি করে রেখেছে। এখন শুধু পুরো বিষয়টা দেখে নিয়ে অ্যাকশনে যেতে হবে। বিড় বিড় করে শুধু বলল, সাত হাজার ছয়শ মাইল!


২.


ওপরের গল্পটি কাল্পনিক। আমি একটি সায়েন্স ফিকশন লিখছি। ইংরেজিতে; আন্তর্জাতিক পাঠকদের জন্য। এটা তারই প্লট।


এই নিবন্ধের সঙ্গে কিছু ছবি যুক্ত করেছি। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আর জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল সমুদ্রতীরে মধুর সময় কাটাচ্ছেন। আইনস্টাইন সেলফি তুলছেন। এগুলো কিন্তু সত্যিকারের ছবি নয়। বর্তমান সময়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটার তৈরি করেছে। আমরা জানি, ফটোশপ করে ছবি জোড়া দিয়ে নতুন নতুন কোলাজ করা যায়। কিন্তু এগুলো ফটোশপ দিয়ে তৈরি নয়। এগুলো কম্পিউটার নিজ থেকেই তৈরি করেছে।


কিছদিনের মধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন জায়গায় চলে যাবে যে, তারা অন্যের ভয়েস তৈরি করে দিতে পারবে। অন্যের ভিডিও তৈরি করে দিতে পারবে। দেখা যাবে, দু’জন মানুষ খুবই অন্তরঙ্গ অবস্থায়– যেখানে বাস্তবে তাদের কখনও দেখাই হয়নি।


অর্থাৎ কোনটি আসল আর কোনটি নকল, সেটি খালি চোখে বুঝতে পারা অসম্ভব হয়ে যাবে। মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো যেমন চামড়া, চোখ, কান, নাক, জিহ্বা যে ডাটা ব্রেইনে পাঠায়, তা দিয়েই ব্রেইন বুঝতে পারে কোনটা কী! খুব শার্প ব্রেইন যাদের, তারা যা বুঝে ফেলতে পারে, অতি সাধারণ ব্রেইন তার কিছুই পারে না। তবে ব্রেইন আবার লার্ন করতে পারে। সেই জন্য আমাদের লেখাপড়া করতে হয়, শিখতে হয় এই ব্রেইনকে আপডেট রাখার জন্য।


বিগত কয়েক দশকে কম্পিউটার বিজ্ঞান এমন একটা জায়গায় চলে এসেছে, তার অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের চেয়ে বেশি ক্ষমতা পেয়ে গেছে। তারা এমন সব কাজ করতে পারছে; এমন সব সিস্টেম চালাতে পারছে; কম সময়ে এত বেশি তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারছে, যা মানুষ আর পেরে উঠছে না।


৩.


ওই গল্পটি যদি আমি আমার দাদিকে বলতাম, তাহলে তিনি বলতেন– হ বুঝছি। তুই আমারে ঠাকুর মা’র ঝুলি শুনাইতেছিস। এই একই গল্প যদি আমি আমার মাকে বলতাম; তিনি মুচকি হেসে বলতেন, অশিক্ষিত মা পাইয়া আমার সাথে খালি শয়তানি করিস! আমার মাকে যদি বারাক ওবামার সঙ্গে মার্কেলের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিগুলো দেখাতে পারতাম; মা বলতেন,ওয়াস্তাগফিরুল্লাহ! কেয়ামতের আর বেশিদিন বাকি নাই!


সায়েন্স ফিকশনের গল্পটা আমি আমার স্ত্রীকে বললাম। সে বলল, সিনেমায় তো এমন দেখাচ্ছে। গল্পটা তো মনে হচ্ছে ভালোই হবে। আমার দুই মেয়েকে বললাম। বড়টা বলল, এটা তো এখুনি হতে পারে। আই ক্যান সি ইট হ্যাপেনিং। ছোটটা এখনও ছোট। তবে বলল, তার কাছে গেমের মতো মনে হচ্ছে। সে ভাবছে, ড্রোনটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কিনা!


ধরুন, মফস্বল শহরের একজন শিক্ষককে আমরা গল্পটা বললাম। তিনি কি বিশ্বাস করবেন, এটা বাস্তবে হতে পারে? আরেকটু দূরে গিয়ে উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষক বা ওই বয়সী মানুষদের বললে, তারা কীভাবে বিশ্বাস করবে? কিংবা আরও গ্রামে গিয়ে একজন কৃষক, নয়তো গৃহবধূকে গিয়ে যদি আপনি গল্পটা বলেন, তাহলে সে কীভাবে নেবে এটাকে? সে কি ভাববে, ইট ইজ হ্যাপেনিং নাও?


আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ বিশ্বাস করেছিল– সাঈদী সাহেবকে চাঁদে দেখা গিয়েছিল। এটাই তো বাস্তবতা; তাই নয় কি?


এবার যদি অক্সফোর্ডে যাই? কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার ভালো শিক্ষত মানুষদের জিজ্ঞেস করি? তারা কী বলবে? এফবিআই? সিআইএ? কিংবা মোসাদ?


৪.


গত শতাব্দী থেকে যখন তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ হতে থাকে, তখন একটি শব্দ খুব চালু হলো– ডিজিটাল ডিভাইড। যার কাছে ডিজিটাল অ্যাক্সেস আছে, আর যার কাছে নাই; তাদের ভেতর দূরত্ব অনেক। যে মানুষটার কাছে স্মার্টফোন নেই, ইন্টারনেট নেই, ল্যাপটপ নেই; তাদের সঙ্গে অন্য সমাজের দূরত্ব অনেক বেশি। সেই দূরত্ব অনেক দিক থেকেই– অর্থনৈতিক দূরত্ব, বুদ্ধির দূরত্ব, মানসিকতার দূরত্ব, চিন্তা-ভাবনার দূরত্ব, গণতন্ত্রের দূরত্ব, সুশাসনের দূরত্ব। সার্বিকভাবে দুটো ভিন্ন গোত্র তারা। তাদের আচরণ ভিন্ন, চিন্তাভাবনা ভিন্ন; এক্সপ্রেশন ভিন্ন। একটু ভালো করে তাদের ভিডিওগুলো দেখবেন। তাদের বডি ল্যাংগুয়েজও ভিন্ন!


সেই দূরত্ব দূর করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকার তাদের জনগণকে ডিজিটাল সেবার ভেতর আনার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। বিশ্বের অনেক দেশ এই ক্যাম্পেইনের ফলে অনেকটাই দূরত্ব কমাতে পেরেছে বৈ কি! কিন্তু ২০২০ সালের পর থেকে নতুন করে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছে এবং সেটিও ডিজিটাল ডিভাইড; তবে তথ্যের অ্যাক্সেস আছে আর নেই– এমনটা নয়। তার মাত্রাগত দূরত্ব বেড়ে গেছে। আমাদের এখন ডিজিটাল ডিভাইসে অ্যাক্সেস আছে। ওই পর্যন্তই। বাকি পৃথিবী তো অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে আমাদের দূরত্বটা আরও বেড়েছে। আমাদের সঙ্গে উন্নত বিশ্বের সম্পর্ক আরও বেশি প্রভু-ভৃত্যের মতো। আমরা এই পাশে বসে ফেসবুক কিংবা টিকটক ব্যবহার করে লাফালাফি করছি আর প্রশান্তির ঢেঁকুর তুলছি– আমরা ডিজিটাল হয়ে গেছি। ওই পাশে বসে যিনি ফেসবুক তৈরি করেছেন, তিনি আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে মিটিমিটি হাসছেন।


এটা বর্তমান সময়ের ডিজিটাল ডিভাইড। একটি ফেক ছবি বা ভিডিও দেখে আপনি হয়তো এলাকায় মারামারি লাগিয়ে দেবেন। কারণ, ওটা যে ফেক– সেটা বোঝার মতো সক্ষমতা আমাদের থাকবে না। আর যাদের থাকবে, তারা সেভাবেই সেটিকে ব্যবহার করবে। এই বিভাজনটা তৈরি করবে– কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় কোন সমাজের সক্ষমতা কতটুকু তার ওপর। যাদের সক্ষমতা বেশি হবে, সেই সমাজ ততটা এগিয়ে থাকবে। সেই দেশের ছেলেমেয়েরা সেইভাবে বড় হবে; সেভাবেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করবে। আর যাদের কাছে এই সক্ষমতা থাকবে না, তারা ওই মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপের ব্যবহারকারী হয়ে ভৃত্যের মতো জীবন-যাপন করবে। এটিকে বলা যাবে ‘মডার্ন স্লেভারি’ বা আধুনিক দাসত্ব! একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন তো। আমাদের এক সময় ২০ কোটি মানুষ হবে, যার বেশিরভাগই হবে নিচু স্তরের শ্রমিক। আরেকটি দেশ, যার জনসংখ্যা মাত্র ১ কোটি, কিন্তু তার কাছে আরও ১৯ কোটি বুদ্ধিমান রোবট আছে। তাহলে কার সক্ষমতা বেশি থাকবে?


এই দশকে এসে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো নতুন করে আরেকটা ডিজিটাল ডিভাইডের ভেতর পড়ে গেল। এর ভেতর দিয়ে আমাদের সমাজের সঙ্গে উন্নত সমাজ ব্যবস্থার দূরত্ব আরও বাড়বে, যে দূরত্ব কমানোর মতো সক্ষমতা আমাদের এখনও তৈরি হয়নি।


পুনশ্চ: এই নিবন্ধ যেদিন লিখছিলাম, সেদিন বাংলাদেশ তার ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছিল। দেশ হিসেবে তাকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে!

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us