সম্প্রতি টোকিওর হানেদা বিমানবন্দর থেকে একটি উড়োজাহাজ ৩৫০ জন যাত্রী নিয়ে দেশটির উত্তরের হোক্কাইডো দ্বীপের ফুকুওকা বিমানবন্দরে রওয়ানা দিয়েছিল। এক হাজারেরও বেশি কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে হাজির হলেও মাত্র ১০ মিনিটি দেরীতে পৌঁছানোর ফলে জাপান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট জেএল-৩৩১ বিমানটিকে ফুকুওকায় অবতরণ করার অনুমতি দেয়া হয়নি। অবতরণ করতে না পেরে অগত্যা বিমানটি সাত ঘন্টা ঘুরে ঘুরে উড্ডয়ণ করে পুনরায় হানেদা বিমানবন্দরে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছিল। এজন্য যাত্রীদেরকে রাতে থাকাসহ ২০ হাজার ইয়েন করে নগদ ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছিল!
বিমানটিতে নারী, শিশুসহ ৩৫০ জন যাত্রী ছিল। অনেকের পরদিনই কর্মস্থলে যোগদানের কথা ছিল। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে একটি শৃংখলা হিসেবে ধরা হলেও খুব কঠোর ও অমানবিক বলে মনে হয়েছে অনেকের কাছে। আবার অনেকে বলেছেন, এটা এমন আর কি? এটাই জাপানীজদের সময় জ্ঞানের নমুনা!
ফুকুওকার আশেপাশের বিমানবন্দরে যে অবতরণের চেষ্টা করা হয়নি এমনও নয়। ফুকুওকা বিমানবন্দরের পাশের বিমানবন্দরের নাম হলো কিতাকিউশু। পাইলট সেখানে বিমানটিকে অবতরণের চেষ্টা করলে টাওয়ার থেকে উত্তরে জানানো হয়- রাত্রি যাপনের জন্য তাদের আশেপাশে ৩৫০ জন যাত্রী ধারণ ক্ষমতার হোটেল খালি নেই। এমনকি বিমানবন্দর থেকে এতগুলো যাত্রীকে বহন করে ফুকুওকা নিয়ে যাবার মতো পরিবহন নেই। অর্থাৎ, হঠাৎ করে ৩৫০ জন যাত্রীকে সেবাদানের জন্য তাদের কোন ব্যবস্থা নেই। শেষমেশ, সবকিছু হিসেব করে বিমানটি পুনরায় উৎপত্তিস্থলে ফেরত আসতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
ফুকুওকা একটি পরিচ্ছন্ন শান্ত কেন্ বা জেলা। সেখানকার বিমানবন্দরটি নির্মিত হয়েছিল একটি জনবসতি ও তাদের কৃষিজমিকে অধিগ্রহণের মাধ্যমে। জমি াধিগ্রহণ করার সময় স্থানীয় অধিবাসীরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাদের সাথে নানা বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার পর বিমানবন্দরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর একটি বড় শর্ত হলো- যেহেতু জনবসতির অতি কাছে বিমানবন্দর তৈরী করা হবে সেহেতু রাত দশটার পর কোন বিমান উঠানামা করতে পারবে না।
অর্থাৎ, রাত দশটার পর বিমান ওঠানামার বিকট শব্দদূষণ এড়িয়ে ভালভাবে নিদ্্রাযাবার জন্য অধিবাসীরা খুব বেশী সচেতন। তারা মনে করেন, রাতের বিকট শব্দ তাদের নিদ্রা কেড়ে নেবে এবং সন্তানদের পড়াশুনায় বিঘন ঘটাবে, বয়স্ক ও রোগীদের অসুখ আরো বাড়িয়ে তুলবে। এত তাদের মানসিক অসুবিধা সৃষ্টি হবে, স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে এবং পরদিন কাজের প্রতি অনীহা তৈরী হবে। এ থেকে তাদের উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। আরো অনেক কিছু তাদের দাবীনামার মধ্যে ছিল। যেগুলো মেনে নিয়ে ফুকুওকা বিমানবন্দরটি তৈরী করা হয়েছিল। সেজন্য রাত দশটার পর সেখানে কোন বিমান ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। তাই দশ মিনিট দেরীতে বিমান অবতরণের অনুমতি দিলে সেটা সেইসব শর্তের অপলাপ করা হয় মাত্র। এছাড়া পরবর্তীতে জনরোষের ভয় তো আছেই।
এতে প্রমাণিত হয়েছে যে ‘পাবলিক ন্যুইসেন্স’ বা জন বিরক্তির উদ্রেককারী কোন বিষয় সম্পর্কে জাপানীরা কতটুকু সজাগ। বোঝা যায় জন উপদ্রব, নাগরিক আপদ ও সময়জ্ঞানের ব্যাপারে ওদের কঠোরতা।
সময়জ্ঞান ও সময়ের কাজ ঠিক সময়ে সম্পন্ন করার অভ্যাস নিয়ে ওদের কঠোর চর্চ্চা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষদের থেকে আলাদা মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। আমাদের বাঙালী সময়জ্ঞান ওদের দেশে গিয়ে দু-একবার অনিয়মে পড়ে ধাক্কা খেলে ওদের মতো টনটনে হয়ে ওঠারও নজির রয়েছে। ছোটখাটো অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঝড়-বৃষ্টি বাদল হলে আমরা অনেকে অফিস-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকে ফাঁকি দিই। ওদের সে বদভ্যাস নেই।
বহু বছর আগে কোন এক স্নো-ফলের কঠিন ঠান্ডা দিনে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছোট্ট ঘটনা মনে পড়লো। এক প্রফেসরের চেম্বারের সামনে রাখা বাক্সের মধ্যে এ্যসাইনমেন্ট জমা দেবার শেষ সময় উল্লেখ ছিল দুপুর দুটা। কিন্তু তার আগে প্রায় দুদিন ধরে তুষারপাতের ফলে ক্যাম্পাসের রাস্তা বরফে জমে পিচ্ছিল হওয়ায় গাড়ি বাদ দিয়ে হেঁটে রওয়ানা দিয়েছিলাম। একা একা হেঁটে যেতে আমার ভয় ও কষ্ট দুটোই হচ্ছিল। কারণ, চারদিকে সাদা চাদরে ঢাকা। জনমানব নেই। ভেবেছিলাম আমার বাইরে বের হওয়াটাই বোধহয় ভুল হলো। কিন্তু যখন চেম্বারের সামনে পৌঁছুলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় আড়াইটা বেজে গেছে।