একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যা জেনোসাইড-এর একটি অংশ। ২৫ মার্চ কালরাত থেকে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যায় বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল একদম ছক কাটা।
একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের খুব খেয়াল করে দেখলে দেখা যায় যে তাদের প্রত্যেকেই ভাষা-আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে কোনো-না-কোনো উপায়ে যুক্ত ছিলেন। আগামীর মেধাহীন রাষ্ট্র হবে বাংলাদেশ, এই ছকে ফেলে বেছে বেছে শুধুমাত্র সেইসব প্রতিবাদী, সাহসী এবং স্বাধীন বাংলা ভূমির জন্য কাজ করা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। তাদের খুঁজে পেতে সহায়তা করেছিল রাজাকার ও বিহারীরা।
১৯৪২ সালের ২০ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের খিদিরপুর পাইপ রোডের ৬৩/১ বাড়িতে মেহেরুন্নেসার জন্ম হয়। তার বাবার নাম আব্দুর রাজ্জাক এবং মায়ের নাম নূরুন্নেসা। তাদের চার সন্তানের মাঝে মেহের ছিলেন দ্বিতীয়। মেহেরকে আদর করে বাবা-মা রানু বলে ডাকত। বড় কন্যা মোমেনা খাতুন এবং মেহেরের জন্মের পর আরও দুই পুত্র সন্তান জন্ম নেয়, তারা হচ্ছেন রফিকুল ইসলাম বাবলু এবং শহিদুল ইসলাম টুটুল।
আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য মেহের স্কুলে যেতে পারেননি। বড় বোন মোমেনা খাতুন তাকে বাড়িতে পড়াশোনা করাতেন। ছেলেবেলা থেকেই সৃজনশীল রচনায় মেহের পারদর্শী হয়ে উঠেন। বড় বোনের উৎসাহে লিখতে-পড়তে শেখার পাশাপাশি কবিতা লেখায় মন দিয়েছিলেন।
মেহেরের পিতার কয়লার দোকান ছিল। শিশু বয়সেই বাবার সাথে তিনি সেই দোকানে যেতেন। টাকাপয়সার হিসাব রাখতে শিখেছিলেন সেখানেই।
দেশভাগের পর মেহেরের পরিবার দাঙ্গার শিকার হয়। দাঙ্গায় লুটপাট হয়ে যাওয়া দোকান থেকে সঞ্চিত অর্থ নিয়ে ১৯৫০ সালে মেহেরের পরিবার ঢাকায় চলে আসেন। তাঁতিবাজার, ফরাশগঞ্জ, দয়াগঞ্জ, শাহজাহানপুর, কমলাপুর, ঋষিকে দাশ এলাকাগুলোয় ভাড়া বাড়িতে থেকে শেষ ঠিকানায় উঠেন বিহারী অধ্যুষিত এলাকা, মিরপুরে।
ছেলেবেলা থেকে পরিবারকে আর্থিক অসচ্ছলতার মাঝে চলতে দেখে মেহের সবসময়ই বিচলিত থাকতেন। বিশেষ করে ঢাকায় আসার পর তিনি সংসারে সাহায্য করার পথ খুঁজতে থাকেন। কিছুদিন ইউসিস-এ কপিরাইটার হিসেবে কাজ করেন। তারপর বহু চেষ্টাতে বাংলা একাডেমিতে কপিরাইটার হিসেবে চাকরি পান।
এখানে বহুদিন কাজ করার পর ১৯৬৫ সালে তিনি ফিলিপস্ কোম্পানিতে চাকরি নেন। ভাগ্য তার সাথে কখনোই সঠিক আচরণ করেনি। কারণ এরপরই মেহেরের বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। পাগলের মতো অর্থ জোগাড় করতে ওভার টাইম শুরু করেন তিনি। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন ছোট ভাই বাবলু।
জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে ফিলিপস্ ওয়ার্কশপে রেডিও মেরামতের কাজও শুরু করেছিলেন তিনি। প্রতিবাদী দেশপ্রেমী মেহের থেমে থাকেননি, সেই সময় ফিলিপস্ ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় মুখপত্র ছাপাতো, তার চেষ্টায় বাংলা ভাষায় রচিত পত্রিকাও প্রকাশে বাধ্য হয়েছিল ফিলিপস্ কর্তৃপক্ষ।
জীবনে কবিতার প্রতি ভালোবাসা, বাংলা সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণ তাকে সাহিত্য চর্চা থেকে দূরে থাকতে দেয়নি। তার সৃষ্টি ছাপা হয়েছে, ‘ইত্তেফাক’, ‘বেগম’, ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘যুগের দাবী’-সহ অনেক কাগজ ও সংকলনে। 'রানু আপা' ছদ্মনামে রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখেছেন ১৯৬৯-এর আইয়ুব বিরোধী উত্তাল গণআন্দোলনে।