প্রতিবছর এই সময়টায় আপনি দেশে আসেন, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে?
রথীন্দ্রনাথ রায়: আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শব্দসৈনিক। যদিও আমি প্রবাসে থাকি, তবুও এই সময়টায় দেশে আসার জন্য মনটা আনচান করে। যেহেতু এই দেশের জন্মের সঙ্গে আমরা জড়িত। সেহেতু নাড়ির টানেই মাতৃভূমিতে আসতে আমার মন আমাকে বাধ্য করে। তাই বাংলাদেশ আমার কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
এবার কবে এলেন?
রথীন্দ্রনাথ রায়: আসলে প্রতিবারই বিজয় দিবসকে উপলক্ষ করে ডিসেম্বরে দেশে আসি। কিন্তু আমার একটা চোখের অস্ত্রোপচার হওয়ায় গত বছর আসা হয়নি। এ বছর জানুয়ারিতে এসেছি।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনারও বিরাট ভূমিকা ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দসৈনিক আপনি। সেখানে আপনার যুক্ততা। একটু স্মৃতিচারণা করবেন কি?
রথীন্দ্রনাথ রায়: ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলার পর প্রথমে ২৭ মার্চ পরে ২৯ মার্চ জরুরি অবস্থা ভঙ্গ করা হয়। আমরা থাকি লক্ষ্মীবাজারে। আমাদের পাশে একটি পরিবার ছিল। ওই পরিবারের ছেলে কাজল আমাকে এসে বলল, তোমরা কি রংপুর যাবে? আমি বললাম, এখন তো রংপুর যাওয়া অসম্ভব। কাজল বলল, আমরা বিক্রমপুর চলে যাচ্ছি, তোমরা চাইলে আমাদের সঙ্গে যেতে পারো। আমি বাবাকে (হরলাল রায়) গিয়ে বললাম, জরুরি অবস্থা উঠে গেছে। বাবা চলো আমরা বিক্রমপুর চলে যাই। বাবা কিছুতেই রাজি না। উল্টো বললেন, কিছুদিনের মধ্যেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমি তখন বললাম, বাবা শাঁখারী বাজার, ফরাশগঞ্জে হামলা হয়েছে। ওদের টার্গেট হিন্দু। এর পর কিন্তু লক্ষ্মীবাজার। আর এখানে ওদের প্রথম টার্গেট হব তুমি এবং আমি। বাবাকে অনেক বুঝিয়ে আমরা এরপর বিক্রম পুর সুরেশ তপাদারের বাড়ি চলে যাই। সেখানে কিছুদিন থাকার পর জুনে আমরা তিন বন্ধু মিলে ঠিক করি আগরতলা যাব। এরপর বিক্রমপুর থেকে কিছু পথ হেঁটে কিছু পথ নৌকায় পাড়ি দিই। এরপর কুমিল্লা থেকে বেবিট্যাক্সি গোমতীর বাঁধ হয়ে কাবিলার হাঁট। সেখান থেকে পাঁচ মাইল হেঁটে বর্ডার। এরপর ১৪ জুন আমি পৌঁছাই ৫৭/৮, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
সেখানে গিয়ে কার কার দেখা পেলেন?
রথীন্দ্রনাথ রায়: মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, মুকসেদ আলী সাঁই, মান্না হক, শহীদুল ইসলাম, আশরাফুল আলম, কামাল লোহানীসহ আরও অনেকের দেখা পাই। আমাকে দেখে কামাল লোহানী, ওই তো রথীন এসে গেছে আর চিন্তা নেই।
আপনি একুশে পদক পেলেও স্বাধীনতা পদক পাননি—এই নিয়ে আপনার কোনো আক্ষেপ আছে কি?
রথীন্দ্রনাথ রায়: চলচ্চিত্রের গানের জন্য আজ পর্যন্ত জাতীয় পুরস্কার পাইনি। মুক্তিযুদ্ধে শব্দসৈনিক হিসেবে গান দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি, স্বাধীনতা পদক পাইনি। এ নিয়ে যতটা না আক্ষেপ, তার চেয়ে বেশি আক্ষেপ আমার বাবা হরলাল রায়, তিনি রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক—কোনোটিই পাননি। বাবা এই সম্মানটুকু পেলে আমার কোনো আক্ষেপ থাকত না।