শরীরবৃত্তীয় কাজের জন্য শক্তি প্রয়োজন। আহারের মাধ্যমে খাদ্য থেকে আমরা এ শক্তি পেয়ে থাকি। খাদ্যগ্রহণ বা আহার আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। খাবার খাওয়ার সুন্দর, পরিচ্ছন্ন ও নিয়মিত প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী খাদ্যগ্রহণ বা খাদ্যগ্রহণের আচরণগত সমস্যা যখন শারীরিক স্বাস্থ্য বা মনোসামাজিক কর্মক্ষমতা ব্যাহত করে, তখন তাকে বলে খাদ্যগ্রহণ বা আহার ব্যাধি। যেকোনো বয়সে যেকোনো মানুষের এ রোগ হতে পারে। খাদ্যগ্রহণ ব্যাধি শুধু খাবারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এটি একটি জটিল মানসিক রোগ, যা একজন ব্যক্তির খাবার গ্রহণ প্রক্রিয়া ও ভাবমূর্তিকেও প্রভাবিত করে।
খাদ্যগ্রহণ ব্যাধির উপসর্গ
এ রোগ বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। খাদ্যগ্রহণ ব্যাধির সতর্কতামূলক উপসর্গগুলো—
ক. আবেগ এবং ব্যবহারজনিত উপসর্গ
১. ওজন কমে যাওয়া, খাওয়া নিয়ন্ত্রণ, খাবার নিয়ম বা খাওয়ার ধরন নিয়ে বিশ্বাসের অসামঞ্জস্যতা।
২. তীব্র আবেগের পরিবর্তন।
৩. বারবার আয়নায় চেহারা দেখা।
৪. খাবার বিষয়ে সবার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, সামাজিকতা পরিহার করা।
৫. ওজন, খাদ্য, খাবারের পুষ্টি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা করা।
৬. একা একা বা লুকিয়ে খাবার খাওয়া।
৭. না খেয়ে থাকা।
৮. ওজন বেড়ে যাওয়া নিয়ে তীব্র ভয়।
৯. শরীরের গড়ন নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা।
১০. মনোযোগ কমে যাওয়া এবং ভ্রান্ত চিন্তা করা।
খ) শারীরিক উপসর্গ
১. ওজনের তারতম্য (দ্রুত বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া)।
২. কোষ্ঠকাঠিন্য।
৩. রক্তচাপ কমে যাওয়া।
৪. শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন কমে যাওয়া।
৫. ক্লান্তিবোধ, দুর্বলতা এবং অবসন্নতা।
৬. চুল ও নখ ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া।
৭. শুষ্ক ও হলদে ত্বক।
৮. মেয়েদের মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া।
৯. পাতলা ফিনফিনে অপুষ্ট চুল।
১০. পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা।
১১. মাথা ঝিমঝিম, মাথা ঘোরানো।
১২. মাংসপেশির দুর্বলতা।
১৩. শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া।
কিছু খাদ্যগ্রহণ ব্যাধি
বিভিন্ন ধরনের খাদ্যগ্রহণ ব্যাধি রয়েছে। প্রতিটি খাদ্যগ্রহণ ব্যাধির নির্দিষ্ট অনুমাপক রয়েছে, যা অন্য মানসিক রোগ থেকে খাদ্যগ্রহণ ব্যাধিকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে।
অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা: ধারাবাহিকভাবে খাদ্যগ্রহণ মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করা। ওজন বেড়ে যাওয়ার তীব্র ভয় বা মোটা/স্থূল হওয়ার ভয়। এক নাগাড়ে এমন আচরণ করা, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। নিজের ওজন বা গড়ন নিয়ে ভ্রান্ত বিশ্বাস। এসবই অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসার অনুমাপক। ওজন অত্যন্ত কমে যায়। ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে ৮৫ শতাংশ নিচে নেমে আসে। বিএমআই ১৭ দশমিক ৫-এর নিচে নেমে আসে। নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক বন্ধ থাকে।
বুলিমিয়া নারভোসা: মাঝেমধ্যে অল্প সময়ে অতিরিক্ত জাঙ্ক খাবার খেয়ে ফেলা বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অতিরিক্ত খাবার খাওয়া; ওজন বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে অসংগত ক্ষতিপূরণমূলক আচরণ (যেমন গলায় আঙুল দিয়ে বমি করা বা লেক্সেটিভ, ডাইরেটিক ওষুধ খাওয়া বা এনেমা দেওয়া) বা খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা বা মাত্রাতিরিক্ত ব্যায়াম করা বুলিমিয়া নারভোসার কিছু অনুমাপক।
বিনজ ইটিং ডিসঅর্ডার: বুলিমিয়া নারভোসার মতো এসব রোগীও মাঝেমধ্যে অতিরিক্ত জাঙ্ক খাবার অল্প সময়ে খেয়ে ফেলে বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অতিরিক্ত খাবার খায়, তবে ওজন বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে অসংগত ক্ষতিপূরণমূলক আচরণ তারা করে না।
খাদ্যগ্রহণ ব্যাধির ঝুঁকি
খাদ্যগ্রহণ ব্যাধির কারণে অপুষ্টি থেকে শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, রক্ত সংবহনতন্ত্র, হরমোনতন্ত্র ও পরিপাকতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপুষ্টিতে শরীরের ক্ষয় হতে থাকে, যা হৃৎপিণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরিণতিতে হৃৎপিণ্ডের রক্তসঞ্চালন ক্ষমতা কমে যায়। ফলে রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দন কমে যায়, তৈরি হয় হৃৎপিণ্ড অকার্যকর হওয়ার ঝুঁকি।
বমি বা পায়খানা করার ওষুধ বা অতিরিক্ত পানি খাওয়ার কারণে হৃৎপিণ্ড অকার্যকর হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। অপুষ্টির কারণে চর্বি ও কোলেস্টেরল ঘাটতি হওয়ায় হরমোনতন্ত্র বিশেষ করে সেক্স হরমোন ও থাইরয়েড হরমোন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে নারীদের মাসিক অনিয়মিত বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শরীরের অন্তঃ তাপমাত্রা, বিপাকীয় হার এবং হাড়ের ঘনত্বেও প্রভাব পড়ে।
পুষ্টির অভাবে মস্তিষ্কের কাজ ব্যাহত হয়। ফলে মনোযোগ কমে যায়। ঘুমের ব্যাঘাত হয়। ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট বা মাথা ঘোরাতে পারে। অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতার কারণে শরীরের সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটে।
খাদ্য হজম বা খাদ্য শোষণের মতো পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়। দীর্ঘস্থায়ী বমির কারণে খাদ্যনালি ছিঁড়ে যেতে পারে। বিনজ ইটিং ডিসঅর্ডারে পাকস্থলী ছিঁড়ে জীবন সংশয়ও হতে পারে।
কারণ
ক. জৈবিক: পরিবারে কাছের কেউ যেমন মা-বাবা, ভাই-বোনের মধ্যে কারও খাদ্যগ্রহণের ব্যাধি থাকলে এ রোগ হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। জিনগত কারণে খাদ্যগ্রহণ ব্যাধি হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। খাদ্যগ্রহণ ব্যাধির সঙ্গে বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও নেশার যোগসূত্র আছে।
খ. মনস্তাত্ত্বিক: ব্যক্তিত্বের কিছু প্রবণতাও খাদ্যগ্রহণ ব্যাধির আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। যেমন আত্মমর্যাদা কমে যাওয়া, শারীরিক গড়ন নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা বা অতিমাত্রায় আবেগ। বর্তমান বা অতীতের কোনো আঘাত অনেক সময় খাদ্যগ্রহণ ব্যাধির কারণ হয়ে থাকে। খাবার বা শরীরের ওজন বা গড়ন নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এ ব্যাধির আরেকটি অন্যতম কারণ।
গ. পরিবেশগত: একজন ব্যক্তির চারপাশের পরিবেশ ও পরিবেশের প্রভাব যেমন শারীরিক ওজন বা চেহারা নিয়ে আলোচনা, খাদ্যগ্রহণের ধরন এবং এসব নিয়ে নিজস্ব চিন্তাও অনেক ক্ষেত্রেই খাদ্যগ্রহণ ব্যাধির কারণ।
ঘ. সামাজিক: সামাজিক প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে খাদ্যগ্রহণ ব্যাধির কারণ। যেমন চেহারা, ওজন বা সৌন্দর্য নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেককে প্রভাবিত করে। বন্ধুদের চাপ, গণযোগাযোগ মাধ্যম, চলচ্চিত্র এবং সামাজিক সংস্কৃতি খাদ্যগ্রহণ ব্যাধি তৈরি করে।