প্রফেসর রেহমান সোবহান এমন এক পূর্ণ ও ঘটনাবহুল জীবন প্রত্যক্ষ করেছেন, যা রীতিমতো ঐতিহাসিক। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের অভ্যুদয় তার অন্তর্ভুক্ত। আবার পরিমিত ক্ষমতায় কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে তাঁর অংশগ্রহণ সেগুলো কাছ থেকে দেখে প্রতিফলিত করার সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে তিনি ইতিহাস লিখতে আগ্রহী ছিলেন না, অশীতিপর এবং অদম্য এই অধ্যাপক তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থে লিখেছেন গল্প। এটা ঠিক যে, আত্মজীবনীতে কিংবা ইতিহাস হিসেবে অন্যরাও এসব ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। তবে তাঁর উদ্দেশ্য ইতিহাস লেখা নয়; ঐতিহাসিক বর্ণনার বাইরে গিয়ে নিজের গল্প উপস্থাপন করা। তাঁর গল্প একজন সাধারণ মানুষের উপাখ্যান, যাঁর কাছে জীবন পথচলার শুরুতে যেখানে ছিল, সেখান থেকে রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশ প্রতিষ্ঠা করা অনেকটাই অলীক ছিল।
রেহমান সোবহানের জন্ম ১৯৩৬ সালে কলকাতার এক অভিজাত নার্সিং হোমে ব্রিটিশ ডাক্তারের হাতে। বলা যায়, সমাজের সুবিধাভোগী অংশে এবং রুপার চামচ মুখে। মা ঢাকার নবাব পরিবারের মেয়ে; আর বাবা ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশ সার্ভিসের সদস্য, ঘটনাক্রমে স্যানডহার্স্ট একাডেমিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সমসাময়িক। সোবহান নিজেও পড়াশোনা করেছেন অভিজাত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে; দার্জিলিং সেন্ট পল’স স্কুল, লাহোরের এইচেসন কলেজ ও কেমব্রিজ। তাঁর জন্ম থেকে বাংলাদেশের জন্ম পর্যন্ত এক অভাবনীয় পথচলার স্মৃতিকথা নিয়ে উপস্থিত তিনি।
একুশ বছর বয়সে যখন প্রথম ঢাকায় থাকতে এসেছিলেন তখন বাংলায় কথা বলতে পারতেন না; রবীন্দ্রসংগীত শোনেনইনি, নজরুলের কবিতায় প্রাণিত হননি, ইলিশের রসাস্বাদন ঘটেনি। মোট কথা, কেমব্রিজে তিন বছর কাটিয়ে ঢাকায় পদার্পণের সময় রেহমান সোবহান রীতিমতো বাদামি সাহেব। বিদেশে অথবা পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে অথবা বহুজাতিক কোম্পানির নির্বাহীর মানানসই চাকরির বদলে স্বেচ্ছায় ঢাকায় বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; তা আজও অপরিবর্তিত। ঢাকা তিনি ঘর হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন পরিস্থিতির চাপে বা উত্তরাধিকার সূত্রে নয়; শুধু নিজেকে বাঙালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার নীতিগত সিদ্ধান্তে।
কেমব্রিজ থেকে করাচিতে নামার আগে রেহমান সোবহানের পকেটে ছিল পেশোয়ার ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি বিভাগে রিডারের পদে যোগদানপত্র। প্রতি মাসে ৮০০ টাকার আকর্ষণীয় বেতনের সে প্রস্তাব বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বাবাকে বলেছিলেন– আমি ঢাকা ফিরে যাচ্ছি; ওখানে আমি আমার বাড়ি এবং ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। রওনা হলেন নতুন জীবনের পথে। আকাশপথে নয়, স্থলপথে– করাচি, লাহোর, দিল্লি, কলকাতা। কলকাতা থেকে বিমানে ঢাকায় অবতরণ ১৯৫৭ সালের ৩ জানুয়ারি সকালে।
ঢাকায় তিনি আগন্তুক। তবে মনে পড়ল, ১৯৪৮ সালে ১২ বছর বয়সে মা ও ভাই ফারুক সোবহানের সঙ্গে এক মাসের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন। তখনকার পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী নানা খাজা নাজিমুদ্দিনের অতিথি হয়ে ময়মনসিংহ রোডের বর্ধমান হাউসে থাকতেন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলে সেটা রূপান্তরিত হয় বাংলা একাডেমিতে। বাংলা একাডেমির পথে যেতে যেতে এখনও স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে ওঠে প্রথম তলার শয়নকক্ষ, যেখানে তাঁরা তিনজন এক মাস ছিলেন; প্রবেশদ্বার ও পুকুর আগের মতো অক্ষত। তখন কোনো ইস্কাটন, তেজগাঁও কিংবা ধানমন্ডি ছিল না– সব খোলা জায়গা।