গ্যাস, বিদ্যুৎ, তেল ও সারের দাম বৃদ্ধি
গ্যাস-বিদ্যুৎ-তেল-সার দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। আরেকটি ‘মৌলিক’ অধিকার হলো এনার্জি বা জ্বালানি। জ্বালানির অধিকার কিংবা ডেটার অধিকার খুব শিগগিরই মৌলিক অধিকারের সমতুল্য হতে যাচ্ছে, কিংবা ইতিমধ্যে হয়ে পড়েছে।
সার কীভাবে জ্বালানির সাথে জড়িয়ে পড়ে? কেননা সার উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাস প্রয়োজন হয়। যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্য ওঠানামা করছিল, এই বাজার যে এখন খুব স্থিতিশীল তাও বলা যায় না, তাই এসবের মূল্যও ওঠানামা করছিল।
আমাদের জালানি ব্যবস্থা গ্যাস ও তেলের উপর নির্ভরশীল। এর একটা বড় অংশ আমাদের বাইরে থেকে কিনতে হয়। অন্যদিকে আমাদের নিজেদের গ্যাস মজুদও স্বাভাবিক নিয়মেই কমে আসছে। ফলে উত্তোলিত গ্যাস ভাগ করে নিতে হচ্ছে—কিছুটা বিদ্যুতের উৎপাদনে, কিছুটা সার তৈরিতে।
এই ভাগাভাগিতে দামের সমন্বয় করতে হচ্ছে। উপরন্তু জ্বালানিতে সরকারি ভর্তুকিও একটা আছে। সেই ভর্তুকি কমানোর কিছু চাপ আছে। এই চাপ কিছুটা অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির কারণে, কিছুটা বৈদেশিক ঋণের শর্তের গৌণ মোকাবিলায়। এইসব মিলিত ফলের কারণে এই দাম বৃদ্ধি।
সৌর শক্তি বা সোলার প্যানেল বাস্তবায়ন
সোলার প্যানেল বা সৌর বিদ্যুৎ একটা যুগোপযোগী নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস। এটি মূলত অর্ধপরিবাহী কেলাস থেকে নির্মিত পাতলা টিকলি। যা বিশেষ বৈদ্যুতিক সংযোগের অধীনে সূর্যরশ্মিকে বিদ্যুৎ প্রবাহে রূপান্তর করে। এর কিছু সমস্যা রয়েছে—এতে অনেক জায়গা লাগে, এর অ্যাফিশিয়েন্সি বা রূপান্তর দক্ষতা অনেক কম।
জায়গার ব্যাপারটা এরকম—মোটাদাগে একশ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য সৌর প্যানেলের জায়গা লাগবে প্রায় সোয়া-তিনশ একর জমি। এটা কৃষিজমি যেখানে প্রাধান্য পায়, সেখানের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জের। তাছাড়া বিগত বছরগুলোয় সোলার প্যানেলের মূল্যও বেশি ছিল, যেটা এখন অনেক কমে এসেছে।
আইএমএফের ঋণ কি দায়ী?
আইএমএফের ঋণ কতখানি দায়ী সেটা অর্থনীতিবিদরা বলতে পারবেন। সাদা চোখে কিছু তো বর্তায়ই। বিদেশি ঋণ যখনই নেবেন, তারা কিছু শর্ত তো দেবেনই। সেই শর্ত পূরণ করতে হয়তো এই সব ড্রাস্টিক মেজারমেন্ট নিতে হচ্ছে। কিন্তু এটা আমাদের পক্ষে নিশ্চিত বলা সম্ভব নয়।
আমরা যেটা বলতে পারি, জ্বালানির মূল্য সহনীয় রাখা রাজনৈতিক সুবিধার জন্যও প্রয়োজনীয়। মানুষের অর্থনৈতিক প্রাণ যাতে ওষ্ঠাগত না হয় সেদিকে নীতিনির্ধারকদের নজর দিতে হবে। উদোর পিণ্ডি যেন বুধোর ঘাড়ে না যায়। কিন্তু অন্য দেশেও জ্বালানির মূল্য নিয়ে তুলকালাম চলছে, আন্তর্জাতিক এই ওঠানামা এবং বৈশ্বিক মন্দার দিক মাথায় রাখলে বাংলাদেশেও যে এমনটি হবে সেটা অনিবার্য ছিল। আশা করছি, অর্থনীতির পরিচালকগণ এমনভাবে সামনের দিনগুলোয় পরিকল্পনা সাজাবেন যাতে এই মূল্যবৃদ্ধি সহনীয় হয়।
ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি শিল্প যখন হুমকির মুখে
ক্ষুদ্র শিল্প বড় হুমকির মধ্যেই পড়বে। এবং গ্রীষ্মের আগামী দিনগুলোয় কীভাবে বিদ্যুতের লোডশেডিং হবে, গ্যাসের রেশনিং হবে সেইসব পলিসির ওপর আমাদের প্রবৃদ্ধিও নির্ভর করবে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, সরকার সেসব নিয়ে ভাবছে এবং এখনই স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করছে।
আমাদের দরকার, এমন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যা বাজারের প্রতিঘাত সহনীয় রাখে—অর্থাৎ আমদানি-রফতানির বিক্ষোভ এবং ডলার বিনিময় হারের ওঠানামা যথেষ্ট কুশনিং করে। এর সমাধান প্রযুক্তির হাতে নেই এই মুহূর্তে, যতটা এটা পরিকল্পনাবিদ এবং অর্থনীতিবিদদের হাতে। ফলে স্বল্প সময়ে প্রযুক্তির দিক দিয়ে আমি কোনো সমাধান দেখছি না।
তবে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে হয়তো কিছুটা সহনীয় হবে, তারপরও বলা যায় আমাদের গ্রিড নিউক্লিয়ার পাওয়ার নিতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। এই সেদিনও গ্রিড-বিপর্যয় ঘটেছে এবং তার অর্থ আমাদের গ্রিড-রেজিলিয়েন্সি সন্তোষজনক নয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়লেও তার সুফল কি মিলছে?
আমি বলব না যে সুফল মেলেনি। দীর্ঘদিন জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে থেকে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসে অবগাহন করে আমরা বিস্মৃত হয়েছি ২০০৯-পূর্ব বিদ্যুৎহীনতার অভিশাপ।
মারাত্মক সরবরাহজনিত সমস্যা থেকে উত্তরণের তখনকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে-কাজটি আওয়ামী সরকার করেছে তা নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী। তারা যেনতেন প্রকারে সরবরাহ বাড়িয়েছে, নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে ব্যবসায়ীদের নিয়ে এসেছে, তাদের আকর্ষণীয় প্যাকেজ দিয়েছে।
কেননা ব্যবসায়ীদের ডাকলেই তো তারা আসবে না যদি-না তাদের জন্য আকর্ষণ তৈরি করা যায়। এসবই করা হয়েছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্র রাতারাতি তৈরি করা যায় না—তাও মাথায় রাখা দরকার। এরই ফলশ্রুতি জিডিপি বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি।
শতভাগ বিদ্যুতায়নের পর বিদ্যুৎ বিপর্যয়
শতভাগ বিদ্যুতায়ন অর্থ হলো শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় পড়েছে এটুকুই। এখন এর অর্থ এই নয় যে টেকনিক্যালি বিদ্যুতের সরবরাহ থাকবে। কিন্তু এর ফলে একটা ভাইব আসে যে, আমরাও তাহলে বিদ্যুৎ পাব এবং তা সারাক্ষণ।
বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন এবং বৈশ্বিক চাপে পড়ে সেটা প্রায় উল্টো হয়ে গেছে। যখন এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, প্রাকযোগ্যতা যাচাই করা হয়, তখনকার দৃশ্যপট সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল। তখন আশার একটা আলোকবর্তিকা চারিদিকে ছেয়ে ছিল। এরপর এলো করোনা মহামারি। এর রেশ না মিলতেই এলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আপনি এতগুলো ধাক্কা কীভাবে সামলাবেন?