এ শহরের দেয়ালে একটা স্লোগান পড়েছিলাম, তাতে লেখা ছিল, ‘শিক্ষকের বেতের বাড়ি নিষেধ যে দেশে, পুলিশের হাতে লাঠি কেন সে দেশে?’ অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ক্ষেত্রে লাঠ্যৌষধি যদি নিষেধ হয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ওই বস্তু ব্যবহারের হেতু কী? এ-ই হলো কথা। এর মধ্যে যুক্তি কতটা আছে বা নেই, সে বিষয়ে কিছু আলাপ করা যেতেই পারে।
সম্প্রতি লাঠি হাতে পুলিশের পেটানোর একটি ছবি দেখে দেয়ালের ওই কথা আবার মনে পড়ল। একই সঙ্গে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম। কেননা, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেতহাতে আমার কয়েকজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে নিয়ে অম্লমধুর স্মৃতি।
ভাবছিলাম, এখনকার শিক্ষার্থীরা কতই-না ভাগ্যবান! ক্লাসে স্যাররা বকাঝকা হয়তো করেন, অন্য শাস্তিও দেন, কিন্তু লাঠ্যৌষধি! নৈব নৈব চ! আর কখনোই ফিরবে না। কিছু প্রবীণ শিক্ষক এখনো আক্ষেপ করেন, অতি সামান্য হলেও বেতের ব্যবহার প্রয়োজন ছিল। তাঁদের কথা, যেদিন থেকে শ্রেণিকক্ষে বেত নিষিদ্ধ হয়েছে, সেদিন থেকেই নাকি লেখাপড়া গোল্লায় গেছে!
এ মুহূর্তে চোখের সামনে একটি স্কুলের ছবি ভাসছে। স্কুলটির সামনে মাঝারি আকারের মাঠ। আমি বকুলতলার নিচ দিয়ে ক্লাসে যাচ্ছি। অঙ্কের শিক্ষক কালিকৃষ্ণ কাজুড়ী চিকন বেত নিয়ে ক্লাস ঢুকেই শপাং করে বাড়ি দিলেন টেবিলে। সবাই একেবারে চুপ। ব্ল্যাকবোর্ডে ভাগ অঙ্কে সবার চোখ।
সাদা পাঞ্জাবি-ধুতিতে কালিকৃষ্ণ স্যার ছিলেন শুকনো-শাকনা মানুষ। কিন্তু তেজ ছিল মধ্যগগনে গ্রীষ্মের সূর্যের মতো।
হাইস্কুলে আমাদের ইংরেজির শিক্ষক আবদুর রব মোল্লার প্রিয় বেতটির নাম ছিল ‘আবদুল মোতালেব’। আর্টিকেলের ভুল প্রয়োগ কিংবা ভার্বের ব্যবহারে ভুল হলেই অফিস সহকারীকে হাঁক দিতেন, ‘শঙ্কর, আমার আবদুল মোতালেবখানা নিয়ে আয়।’ তবে যে মহাসমারোহে বেত মারার আয়োজন করতেন, প্রকৃতপক্ষে ততটা মারতেন না। পরে বুঝেছি, সেটা ছিল স্যারের এক কৌশল।
এ ক্ষেত্রে উৎসাহী ছিলেন প্রধান শিক্ষক রজ্জব আলী স্যার। কোনো শিক্ষার্থীর যদি ১০ বেত সাজা হতো, কখনো কখনো তিনি দুই দিনে ভাগ করে তা প্রয়োগ করতেন। যেদিন স্যারের মুড ভালো থাকত, সেদিন তিনি পাঁচ ঘা মেরে বাকি পাঁচটি মারার জন্য ধর্মের শিক্ষক শাফি স্যারকে হায়ার করতেন! শাফি স্যার আবার জো হুকুম বলে পাঁচ ঘায়ের জায়গায় কখনো কখনো ছয় ঘা, সাত ঘা মেরে দিতেন! এতে আবার কোনো দুষ্টু ছেলে প্রতিবাদ করে বলত, ‘স্যার, দুই ঘা বেশি দিলেন যে। পরবর্তী সাজা থেকে কিন্তু এই দুই ঘা ডিসকাউন্ট হবে!’
যখন শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে বেত বৈধ ছিল, তখনই যে সব শিক্ষক এর দ্বারস্থ হতেন, তা নয়; আমাদের বাংলার শিক্ষক দাশ শিশির কুমার তাঁর স্বাদু বচনে ক্লাস মোহাবিষ্ট করে রাখতেন। বেত মারার প্রয়োজন হয়নি। পড়া না পারলে বিজ্ঞানের শিক্ষক জহর লাল বোসের তীব্র ভর্ৎসনায় কুঁকড়ে যেতাম আমরা। বেত থেকে তাঁর কথার ঝাঁজ বেশি তীব্র ছিল। এ কথা বলা যেতে পারে, ভালো লেখাপড়ার জন্য লাঠ্যৌষধি মোটেই অপরিহার্য নয়। শিক্ষকের নিজের প্রস্তুতি, দক্ষতা, নেতৃত্ব ও আন্তরিকতা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।