ভারতীয় সুপারহিট সিনেমা ‘পাঠান’ আমদানি করার জোর দাবি উঠেছে এমন সময়, যখন ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’ কিংবা ‘দামাল’-এর মতো ‘বাংলাদেশি বাংলা’ চলচ্চিত্র দিয়ে দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে নতুন জাগরণ শুরু হয়েছে। দাবিটি মূলত চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীদের। কিন্তু সবকিছু ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিলে চলে? সাংস্কৃতিক সত্তা চুরি হয়ে গেলে একটি জাতি ক্রমশ বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। সরকারের উচিত খুব মনোযোগ দিয়ে ‘পাঠান’ চলচ্চিত্রের আমদানিবিষয়ক ইস্যুটি পর্যালোচনা করা।
নির্ভরশীলতার তত্ত্ব অনুযায়ী প্রকৃত উন্নয়ন তখনই নিশ্চিত হয়, যখন সমাজ ও রাষ্ট্র আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করে। বহু দিন পর বাংলাদেশি সিনেমা যখন শিল্পমান বজায় রেখে জনপ্রিয় হচ্ছে, তখন নগদ লাভের লোভে ‘পাঠান’ আমদানি কতটা সমীচীন, সেটি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখতে হবে। লিবারালিজমের নামে সবকিছুর আমদানিই কি রাষ্ট্র অনুমোদন করবে? নাকি দেশের ছেলেমেয়েদের মেধা, সক্ষমতা ও সৃজনশীলতার ওপর ভরসা রাখবে? গরু, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আমরা আত্মনির্ভরশীল হতে পারি; চলচ্চিত্রে নয় কেন? আমদানি-নির্ভরতা যদি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা হয়; সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নয় কেন?
এটাও মনে রাখতে হবে, সিনেমা নানা দিক থেকে একটা রাষ্ট্রের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আলু-পটোলের ব্যবসা আর চলচ্চিত্র ব্যবসা এক নয়। এর সাংস্কৃতিক, এমনকি রাজনৈতিক প্রভাব নিয়েও রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে।
‘পাঠান’ চলচ্চিত্রের গানগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে; চলচ্চিত্র হিসেবে কামিয়েছে হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এটি রোমান্টিক চলচ্চিত্র নয়। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন এজেন্ট পাঠানের সফল মিশনের গল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে সিনেমাটি। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এর ভাষ্যেকে স্বাগত জানানোর কী যুক্তি থাকতে পারে? যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটি রাষ্ট্র সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে কেন? এটা নিশ্চয় গৌরবের কিছু নয়। বিশ্বায়ন, লিবারালিজম, নিউ-লিবারালিজম ইত্যাদি বাস্তবতা অস্বীকার করছি না কেউ। কিন্তু সব সময় আন্তর্জাতিকতার নামে বিদেশি পণ্যকে বাজারে প্রবেশ করিয়ে স্থানীয় সৃজনশীল উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ আর উদ্যমকে দমিয়ে দেওয়ার পরিণতি দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে।
পাকিস্তান আমলে চীন সফরে গিয়ে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীনের সরকার ও জনগণের আত্মনির্ভরশীলতার সুতীব্র ইচ্ছা এবং চর্চা দেখে মন্তব্য করেছিলেন– এই জাতি একদিন বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে! বঙ্গবন্ধুর সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হতে বেশি দিন লাগেনি। বহু দিন থেকে চীন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি। শুধু নিজেদের ওপর বিশ্বাস এবং নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর দৃঢ়প্রতিজ্ঞার বদৌলতে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে।