ব্যক্তির ইতিহাসশূন্যতা ব্যক্তিকে মূর্খ করে, জাতির ইতিহাসশূন্যতায় জাতি অন্তঃসারশূন্য হয়। ইতিহাসচর্চা সে কারণে জরুরি। সব জাতির ক্ষেত্রেই কথাটা খাটে।
বাঙালির জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসে এমন কিছু ভিত্তিসূচক তারিখ ও মাস আছে, যা আলোকোজ্জ্বল। মার্চ এমনই এক মাস, যা ইতিহাসের উজ্জ্বল রশ্মি বিকিরণ করে। ঐতিহ্যগতভাবে এ মাসের শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে দৈনিকগুলোতে লেখা পত্রস্থ হয়। এ শুধু প্রথা নয়, প্রয়োজন। কারণ ইতিহসের চর্চা জরুরি। তবে এসব রচনা নতুন প্রজন্মের কতজন পড়ে, কতজন হৃদয়ঙ্গম করে, আমার তা জানা নেই। আমি নিজেও লিখি, বহুকাল ধরেই ইতিহাসের ঘটনাবলি লিখি। এ কাজ নিজের কাছে আমার নিজের দায়বদ্ধতা। কারণ বহু দল-মতে বিভাজিত, কখনো প্রতারিত বা রক্তাক্ত এই জনপদে ইতিহাসের ঘটনাবলি সমৃদ্ধ সময়ের স্মৃতিচারণা সৎ নাগরিকের আবশ্যিক শর্ত বলে বিবেচনা করি।
আমি ঐতিহাসিক নই, স্বাধীনতার জাতীয় ইতিহাসের একটি পর্যায়ের প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারী মাত্র। সে কারণে চোখে দেখা সময়ের স্মৃতিচারণা করি এবং সেই সময়ের পূর্বাপর পরিপ্রেক্ষিত জানার চেষ্টা করি।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভক্তিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক যে বিভাজন ঘটে, তাতে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। কিন্তু অল্পদিনেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এ বিভক্তি শুধুই পতাকা পরিবর্তনের। কারণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সাবেক পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠী নতুন রাষ্ট্রে স্ব্বাধীনতার কোনো সুফল লাভ করে না, বরং ভিনদেশি উপনিবেশবাদ বিদায় নিয়ে জেঁকে বসে নব্য দেশীয় উপনিবেশবাদ।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর চলতে থাকে নতুন মাত্রার শোষণ। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক ও ধর্মকেন্দ্রিক সেই শাসন-শোষণ পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিকে নতুন চেতনায় জাগরূক করে। বাংলা ভাষার প্রথম আত্মানুসন্ধান ঘটে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, যখন পাকিস্তান গণপরিষদের বৈঠকে ইংরেজি ও উদর্্ুকে দেশের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার এই জবরদস্তির বিরুদ্ধে প্রথম সরব প্রতিবাদ করেন বাঙালি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে জোরালো দাবি তোলেন। এই ঘটনা বাঙালি গণমানসে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এরপর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার মাটিতে এসে উর্দুকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে বৃহত্তর আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। বাঙালি ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ঘটে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তপাত। এসব প্রতিবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার উন্মেষ ঘটে। সেই উন্মেষ বৃহত্তর গণবিক্ষোভের জন্ম দেয় এবং ক্রমান্বয়ে অপ্রতিরুদ্ধ জাতিসত্তার বিকাশ ঘটায়।