১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ আহূত ধর্মঘট সফল করার লক্ষ্যে কর্মসূচি পালনের প্রথা অনুযায়ী প্রতিটি হল থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সব ছাত্র সংগঠনের পৃথক মিছিল বিকেল ৪টার মধ্যে মধুর ক্যান্টিন এলাকায় সমবেত হয়। সেদিনের কথা মনে হলে আজও আমার গা শিউরে ওঠে। সেদিন কেন জানি আমার মিছিলে যেতে ইচ্ছা করছিল না! কিন্তু আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা; মিছিলে না গেলে কি হয়? সেদিন কয়েকজন বন্ধুকে আমার মনের অবস্থা খুলে বলেছিলাম। তারাও আমাকে অনুরোধ করল- যা হয় হবে, মিছিলে থাকো। ডান-বামে খেয়াল রাখো।
মধুর ক্যান্টিনের পাশেই ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের মাঠে আমাদের জমায়েত। সেই জমায়েতে কর্মীদের উজ্জীবিত করার জন্য বক্তব্য দিলাম- যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করতে হবে। তারপর খণ্ড খণ্ড মিছিল মধুর ক্যান্টিনের সামনে সমবেত হলো। নেতারা বক্তব্য রাখলেন। কর্মীদের আরও চাঙ্গা করার জন্য কবি মোহন রায়হান আবৃত্তি করলেন এক বিপ্লবী কবিতা- 'আমাদের মৃত্যুর জন্য আজ কোনো পরিতাপ নেই/ আমাদের জন্মের জন্য আজ কোনো ভালোবাসা নেই'। মিছিলটি শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে দিয়ে রোকেয়া হল পেরিয়ে টিএসসি দিয়ে কার্জন হলের দিকে এগোতে থাকে। মিছিলের সামনে ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও ডাকসু ভিপি আক্তারুজ্জামান, খন্দকার মোহাম্মদ ফারুক, মুনির উদ্দিন আহমেদ, ফজলে হোসেন বাদশা, আনোয়ারুল হক, আবদুল মান্নান, শিরীন আখতার, মুশতাক হোসেন, মুকুল বোস, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর প্রমুখ।
মিছিলটি কার্জন হল পার হয়ে ফুলবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। দাঙ্গা পুলিশ মিছিলের সামনে ও পেছনে অবস্থান নেয়। এ যেন মিছিল নয়; পুলিশি ঘেরাওয়ের মধ্যে জেলখানা। তার পেছনেই ছিল পুলিশের পুলিশবিহীন ট্রাক। আমরা ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি- কী ঘটতে যাচ্ছে আমাদের ভাগ্যে! মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে; আকস্মিক পুলিশের পুলিশবিহীন ট্রাকটি মিছিলের মধ্যে উঠিয়ে দেওয়া হলো। ঘটনাস্থলে শহীদ হলেন ছাত্রলীগ নেতা ইব্রাহীম সেলিম ও দেলোয়ার হোসেন। চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে গেলেন বাসদ ছাত্রলীগের নেতা আব্দুস সাত্তার খান, ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান হাবিবসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্রকর্মী।
সে এক নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ! সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র অর্জনের লড়াইয়ের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করল। নির্বিচারে লাঠিচার্জ করল। ইব্রাহীম সেলিম ও দেলোয়ারের লাশ পুলিশ ছিনিয়ে নিয়ে গেল ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। তার পরের ইতিহাস আরও নিষ্ঠুর-নির্মম। সেই লাশগুলো তাঁদের গ্রামের বাড়িতে পুলিশ পাহারায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো এবং দাফন করা হলো। আজ সেলিম-দেলোয়ারের শহীদ হওয়ার দিনে তাঁদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। সেলিম-দেলোয়ারের আত্মদান সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।