আমরা ভাষার প্রতি বেশ যত্নবান ও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি শুরু হলে। দেশের ৫০টির বেশি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিটি ভাষা টিকিয়ে রাখতে হবে। আমাদের আবেগ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে চলে যায় দেশের বাইরেও। বলে ফেলি, পৃথিবীর একটি ভাষাও যেন হারিয়ে না যায়। ফেব্রুয়ারি পার হলে আমরা হরহামেশাই সব ভুলে যাই।
বাংলাদেশ জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে নানা ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ। আমাদের দেশ তাই এত সুন্দর! এত বৈচিত্র্যময়। বাংলাদেশে মোট ৫০টিরও বেশি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। প্রতিটি জাতিসত্তার রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। তারা এই ভাষা-সংস্কৃতি বুকে লালন করে যুগের পর যুগ বেঁচে আছে, সেই সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে দৃঢ়প্রত্যয়ী। বর্তমানে এই ভাষা-সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়েছে।
পাহাড় ও সমতলের হাতে গোনা দু-একটি বাদে বেশির ভাগ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় বিপন্নের পথে। মাহাতোদের কুড়মালি তেমনই একটি ভাষা। সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা মাহাতো। তাদের ভাষার নাম কুড়মালি। তাদের মোট ৮১টি গোত্র রয়েছে। ভারতের রাঁচি, ঝাড়খন্ড, হাজারীবাগ, পুরুলিয়া, আসাম, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মাহাতোর বসবাস। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে কুড়মালি পঠনপাঠন চলছে।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক ড. খ ম রেজাউল করিম, ভারতের সমাজ-গবেষক ও অধ্যাপক ড. সুধাংশু শেখর মাহাতো এবং লেখক ও গবেষক উজ্জ্বল মাহাতোর দীর্ঘদিনের গবেষণার গ্রন্থ ‘মাহাতো জনগোষ্ঠী: সমাজ ও সংস্কৃতি’ বইয়ে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে ৪০ হাজারের মতো মাহাতো জনগোষ্ঠী বসবাস। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, খুলনাসহ মোট ১৮টি জেলায় কমবেশি এদের বসবাস। তবে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলায় বেশিসংখ্যক আবাস।
কুড়মালি সাহিত্যভান্ডার অনেক তথ্যসমৃদ্ধ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে গনু মাহাতো চরিত্র ও সমরেশ বসুর ‘আম মাহাতো’ উপন্যাসে আম মাহাতো চরিত্র বিশদ বর্ণনা করেছেন। উপন্যাস দুটিতে ফুটে উঠেছে আম মাহাতো ও গনু মাহাতোর শারীরিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
ভারতে এই ভাষার বেশ সাহিত্যকর্ম থাকলেও বাংলাদেশে সাহিত্যকর্ম নেই বললেই চলে। ২০১৩ সালে কুড়মালি ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘কারাম’ রচিত হয়। মুজিব বর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষায় প্রথম ও মূলধারার ভাষায় ১৩তম অনুবাদসংবলিত গ্রন্থ ‘কঁআথুয়েঁন: মাহাতো ডিকশনারি’ প্রকাশিত হয়। ২০২২ সালে বইমেলায় প্রকাশিত হয় শিশুতোষ গ্রন্থ ‘গিদরাগিলাক কুড়মালি’।