আবুল বরকত এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে, আশ্রয়ের খোঁজে। আশা ছিল পাকিস্তান তাঁদের আশ্রয় দেবে। আশ্রয় দিল না, বরং হত্যা করল। রাজপথে। সেই সময়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নতুনভাবে গড়ে উঠছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত একটি পারিবারিক স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি যেন এবং প্রথম বাঙালি শহীদ তিনি, পাকিস্তানের। স্বপ্নের নয়, বাস্তবের। দ্বিতীয়বার উদ্বাস্তু হয়েছে তাঁর পরিবার, তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, প্রমাণিত হয়েছে একেবারে সূচনাতেই, সেই বায়ান্নতেই, যে পাকিস্তান বাঙালির দেশ নয়।
সতেরো বছর পরে বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেক ছাত্র আসাদ, আসাদুজ্জামান, শহীদ হন। পূর্ববঙ্গের ছেলে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি তত দিনে কিছুটা আত্মপ্রতিষ্ঠিত, আসাদের পিতা
স্কুলের প্রধান শিক্ষক, ভাইয়েরা কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার। আবারও প্রমাণিত হলো পাকিস্তান মানুষের মিত্র নয়, বাঁচতে হলে তাকে ভাঙতে হবে।
আসাদের আঠারো বছর পরে শহীদ হলেন নূর হোসেন। ছাত্র নন, মধ্যবিত্ত নন। একেবারে শ্রমিকশ্রেণি থেকে আসা তরুণ, সেভেন-এইট পড়া যুবক একজন। আরেক সময়ের মানুষ, আরেক শ্রেণির প্রতিনিধি। কিন্তু শহীদ, একইভাবে।
আমাদের দেশ শহীদের দেশ। মৃত্যু এখানে পদে পদে কাবু করে জীবনকে। শহীদদের হিসাব হাজারে হয় না, তাঁরা লাখ লাখ। সেই অনেক, অনেকের মধ্যে তিনজন বিশেষভাবে জেগে ওঠেন।
জীবিতদের চেয়ে বেশি জীবন্ত তাঁরা। ক্রান্তিকালের তিন প্রতিনিধি। আমরা মাইলফলক বলতে পারতাম তাঁদের, যদি না কথাটা যান্ত্রিক হতো; বলা যেত ধাপ, যদি না নিষ্প্রাণ ও নিঃসঙ্গ শোনাত।
একটি অভিন্ন স্রোতোধারার তিনটি বাঁক যেন তাঁরা। স্রোত চলেছে মোহনার অভিমুখে, তাঁরা বাঁকের চিহ্ন। এ দেশের মানুষের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মুখপাত্র তাঁরা, সময়ের মুখচ্ছবিও। বরকত, আসাদ, নূর হোসেনের মৃত্যুর আগের জগৎ ও পরের জগৎ এক নয়। আন্দোলনের ভেতর থেকে তাঁরা এসেছেন, এসে আন্দোলনকে এমন এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন, যেখান থেকে আর পেছানোর পথ থাকেনি। স্রোত একই অগ্রগতির স্তরে স্বতন্ত্র।