১৮২৪ সালে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অবিভক্ত বাংলায় স্কুল পর্যায়ে আধুনিক শিক্ষার অভিযাত্রা শুরু হয়। ইংরেজ আগমনের সূত্র ধরে, বিশেষত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর ফলে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, এ দেশে কালান্তরের সূচনা হয়েছিল। কালান্তর বলতে মধ্যযুগের গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক মন্থর, প্রায় স্থবির জীবনব্যবস্থায় অকস্মাৎ গতির সঞ্চার হয়েছিল, তাতে যাপিত জীবনের গ্রামীণ গণ্ডি কেটে বৃহৎ বিশ্বের দ্বার খুলে যায়।
দুই শ বছর আগের ইতিহাস স্মরণ করার কারণ, অর্ধশত বছর ধরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে যে নতুন জ্ঞান ও উদ্ভাবন ঘটেছে, তার যে বাস্তব প্রতিফলন মানুষের জীবনে পড়ছে, তাতে আমরা যে নতুন আরেকটি কালান্তরের সম্মুখীন হয়েছি, তা বলা বাহুল্য। এবার যা ঘটে চলেছে তাকে বলতে হবে এক বৈশ্বিক কালান্তর।
প্রথমত, তথ্যপ্রযুক্তি থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ যেসব নতুন প্রযুক্তি আসছে, তা প্রাপ্তিতে এখনো ধনী-দরিদ্রে পার্থক্য থাকলেও ক্রমে এতে সবার অধিকার-সুযোগ তৈরি হবে। দ্বিতীয়ত, সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে এর চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ দুটিই সবার জন্য বিকাশের পথ খুলে দেবে। সেই বিবেচনা থেকে বলতে হবে যে এই নতুন বৈশ্বিক কালান্তরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষা।
চলমান শিক্ষার উদ্দেশ্যের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি স্কুলশিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক ও উপযুক্ত মানের শিক্ষক নিয়োগ করা যায়নি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংযোগ ক্রমেই ক্ষীণ ও মানহীন, প্রায় যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। ফলে পড়াশোনার অর্থ দাঁড়াল শিক্ষক বা কোচের নির্বাচিত গুটিকয় প্রশ্নের শিক্ষক-কোচ রচিত নির্দিষ্ট উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষায় যথাযথভাবে লিখে দেওয়া। অন্যের প্রশ্নের অন্যের উত্তর মুখস্থ করে কারও পক্ষে শিক্ষার্থী থাকা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ এমন শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করে তাঁর স্কুলশিক্ষার সবটাকেই ‘লোকসানি মাল’ আখ্যা দিয়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে জাতিগতভাবে দিনে দিনে আমাদের লোকসান কেবল বেড়েই চলেছে। কথা হলো আর কত লোকসান আমরা গুনব।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা কম হয়নি, কিন্তু এত চেষ্টাতেও ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার্থীর পরিবর্তে শিক্ষার্থী সত্তা ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ এদিকে বৈশ্বিক কালান্তর বাস্তবেই এসে পড়েছে। এখনকার ছাত্রছাত্রীদের যুগপৎ বাংলাদেশ ও বিশ্বের নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। ফলে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থায় উত্তরণ সময়ের দাবি। সরকার দেশীয় ও বৈশ্বিক এই প্রেক্ষাপটে নতুন যে শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তনের চেষ্টা করছে, তা পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।