সপ্তদশ শতকের ইংরেজ মহাকবি জন মিল্টনের অ্যারিওপ্যাজিটিকা বাক্স্বাধীনতা ও লেখালেখির স্বাধীনতা বিষয়ে এক বাঁধভাঙা রচনা; বইপত্র এবং সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরোপের বিরুদ্ধে এক বিপ্লবী দলিল। মিল্টন অ্যারিওপ্যাজিটিকা লিখেছিলেন ১৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে ১৬৪৩ সালে পাস হওয়া লাইসেন্সিং অর্ডার নামক আইনের প্রতিবাদে। এই রচনার জন্য অবশ্যই তিনি লাইসেন্সের ধার ধারেননি এবং উপস্থাপন করেছিলেন খোদ পার্লামেন্টেই। রাজা প্রথম চার্লসের লাইসেন্সিং অর্ডার অনুসারে, কোনো রচনা বিতর্কিত বিবেচিত হলে গ্রেট ব্রিটেনের সরকার সংশ্নিষ্ট লেখককে শাস্তি দিতে পারে। শুধু তাই নয়, যে কোনো প্রকাশনার পূর্বে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলার কাছে লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। মিল্টনের মূল বক্তব্য হলো, সেন্সরশিপ আসলে সব মানুষকে ভালোত্বের ভান করতে বাধ্য করে এবং সরকারকে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার অবাধ সুযোগ দেয়। যত নিরীহ উদ্দেশ্যেই সেন্সরশিপ আরোপ করা হোক না কেন, তা জনসাধারণের ওপর নিপীড়ন বই আর কিছু নয়। তিনি বলেন, বিতর্কিত লেখার জন্য কোনো ব্যক্তিকেই শাস্তি দেওয়ার অধিকার সরকারের নেই; সাহিত্য ও শিল্পকর্মের ওপর সেন্সর আরোপ করার ক্ষমতা সরকারের থাকা উচিত নয়। সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে লেখকের স্বাধীনতা খর্ব করলে বা শাস্তি দিলে, সরকার অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার চর্চা করতে উৎসাহিত হবে। তিনি বলেন, যেখানে আছে জ্ঞানের তৃষ্ণা, সেখানে আবশ্যক বহু তর্ক, প্রচুর লেখালেখি, অনেক মতামত। বাক্স্বাধীনতার বিষয়ে জন মিল্টন আইনের সাংবিধানিকতা বা অসাংবিধানিকতা বিবেচনায় নেননি, তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, সেন্সরশিপ কিংবা লাইসেন্সের বাধ্যবাধকতা, এসব আসলে প্রয়োগের জন্য নয়, স্রেফ অপপ্রয়োগের জন্য। এ ধরনের আইনকে তিনি অভিহিত করেছেন আনডিজায়রেবল ইডিওলজি, অর্থাৎ অবাঞ্ছিত আদর্শ হিসেবে। প্রথম চার্লস এসব কথায় কান দেননি। রাজা দ্বিতীয় চার্লস ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মিল্টনের দুটি বই নিষিদ্ধ করেছিলেন, জেলেও পুরেছিলেন তাঁকে। অবশেষে অবশ্য ব্রিটিশ শাসকের বোধদয় হয় এবং ১৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বই প্রকাশ-সংক্রান্ত লাইসেন্সিং অর্ডার রদ হয়।
আমরা আজও ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া বহু আইন অনুসরণ করে চলেছি। আমলাতন্ত্রকেও সযত্নে একরূপে বজায় রেখেছি। স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক হয়েও আমরা কিছুই বদলাইনি। ঔপনিবেশিক শাসকদের কর্তৃত্ববাদী আইনকে আজও আমরা পূজা করি। তবে, আমরা বাক্স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করি, যদিও সমালোচনা নিতে পারি না। তীব্র ভাষার অপছন্দনীয় কঠোর সমালোচনা তো সহ্যই করতে পারি না। অ্যারিওপ্যাজিটিকা আমাদের কাছে কেবলই ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য মাত্র, একে বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য মনে করি না। ক্ষমতা খাটিয়ে 'বাজে' সমালোচনা বন্ধ করাতে আমাদের বাহাদুরি। আমরা ইতিহাস থেকে জানি যে, বল প্রয়োগে অসন্তোষ দমন করা যায় না, বরং তা হিংসার জন্ম দেয়। মিল্টনের পর্যবেক্ষণ ছিল যে, অসন্তোষ নেই এমন কোনো জাতি হয় না। সরকার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো অসন্তোষের কারণ খুঁজে বের করা এবং তার সংশোধনমূলক প্রতিকার করা। চিন্তা এবং চিন্তা প্রকাশের ভাষা-ভঙ্গি ক্ষতিকর নিশ্চয়ই হতে পারে। চিন্তা ও যুক্তিতর্ক দিয়ে বিরোধী চিন্তা মোকাবিলাই গণতন্ত্র। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, 'গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের নিজস্ব মতামত প্রকাশের অধিকার থাকে। এ কারণেই গণতান্ত্রিক হতে হলে সহিষ্ণুতার চর্চা থাকতে হয়। কারও মতামত গ্রহণ করতে না পরলেও তার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারার নামই সহিষ্ণুতা। অসহিষ্ণুতা থেকে বিদ্বেষ জন্ম নেয় এবং এর ফলে ভিন্নমত সহিংস আক্রমণের শিকার হতে পারে।' কিন্তু গণতান্ত্রিক হয়েও আমরা সেন্সরশিপ পছন্দ করি। জন মিল্টন সেন্সরশিপের তিনটি ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, লেখালেখির ওপর সেন্সরশিপ লেখকের স্বতঃস্ম্ফূর্ততা ধ্বংস করে। দ্বিতীয়ত, সেন্সরশিপ নতুন ও অভিনব চিন্তার পথরোধ করে। লেখকরা নতুন চিন্তা প্রকাশে ভয় পেলে নতুন চিন্তার চেষ্টা আর কেউই করবে না। তৃতীয়ত, সেন্সরশিপ আরোপের দায়িত্ব যে মানুষের হাতে থাকবে, তাদের বিবেচনা নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার অবকাশ নেই, কোনো না কোনো পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাতিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে সেন্সরশিপ ভুলভাবে প্রয়োগ করা হবে, যে বইগুলো সেন্সরশিপ পাওয়ার কথা সেগুলো প্রকাশিত হবে এবং যে বইগুলো প্রকাশের যোগ্য সেগুলো সেন্সর করা হবে।