বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন ৯, ১০ ও ১১ ফেব্রুয়ারি হোপ ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে শেষ হচ্ছে। এ উৎসবের নানা দিক, ব্র্যাকের দীর্ঘ পথযাত্রা ও আগামীর সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ।
৫০ বছর পূর্তি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য দারুণ এক উদ্যাপনের উপলক্ষ। বছরব্যাপী সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন আপনারা শেষ করছেন ‘হোপ ফেস্টিভ্যাল’–এর মধ্য দিয়ে। এ হোপ বা আশা কিসের?
আসিফ সালেহ: আমরা যারা উন্নয়ন নিয়ে কাজ করি, তাদের নিরাশ হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ এই কথাটা সব সময় আমাদের বলতেন। আমরা সব সময়ই আশার মধ্যে থাকি, সুযোগগুলো কাজে লাগাতে চাই। আর আমাদের এই আশাবাদের ভিত্তি বাংলাদেশের মানুষ। এটা ঠিক যে আমাদের অনেক হতাশা আছে। দেশ হিসেবে আমরা ছোট, জনসংখ্যা বেশি, সেই তুলনায় সম্পদও কম। আমাদের এটা সবারই জানা যে বাংলাদেশ একসময় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি ছিল। সেই জায়গা থেকে কিন্তু আমরা উঠে এসেছি। বাংলাদেশের এই যে সাফল্য, এর নায়ক বাংলাদেশের মানুষ। এটাই আমাদের আশাবাদের জায়গা। আমাদের মানুষেরা যেমন উদ্যোগী, তেমনি অসম্ভব পরিশ্রমী। বিশেষ করে নারীরা।
আমরা দেখেছি, সুযোগের অভাবে অনেকে অনেক কিছু করতে পারে না। ব্র্যাকের উন্নয়ন মডেলে চ্যারিটি বলে কিছু নেই, আমরা এর বদলে সুযোগহীন মানুষের জন্য বিনিয়োগ করার নীতি নিয়েছি। আমাদের কাজ হচ্ছে দেশের উদ্যমী মানুষেরা যাতে সুযোগের অভাবে পিছিয়ে না পড়ে, সে জন্য তাদের কিছু টুলস দেওয়া। আমরা দেখেছি, আমাদের সমর্থন পেয়ে তারা নিজেরা পরিশ্রম করে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পেরেছে। আমাদের গত ৫০ বছরের যাত্রায় এই মানুষেরাই হচ্ছে আমাদের নায়ক ও নায়িকা। এই জায়গাটা থেকেই আমরা আশা নিতে পারি। এই স্পিরিটকে কাজে লাগিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। সামনের দিনের চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাপারে সবাইকে, বিশেষ করে তরুণসমাজকে যুক্ত করার লক্ষ্য নিয়েই এই হোপ ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করতে যাচ্ছি। আমাদের মানুষের ক্ষমতা আছে, গর্ব করার মতো সাফল্য আছে। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে আরও এগিয়ে যাওয়ার যে আশাবাদ, তা আমরা সবাইকে নিয়ে উদ্যাপন করতে চাই।
ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলতেন, মানুষ যখন তার ভেতরের শক্তিটাকে উপলব্ধি করতে পারে, তখন আশার আলো জ্বলে ওঠে। ব্র্যাক যে ৫০ বছর ধরে সামনে এগিয়ে চলেছে, সেই অগ্রযাত্রার মূলমন্ত্র কি এই উপলব্ধি?
আসিফ সালেহ: সমাজের সবার অবস্থা এক রকম নয়। কিছু কিছু গোষ্ঠী আছে, যাদের সাধারণ কিছু সহায়তা দেওয়া হলে পরিশ্রম করে নিজেদের ভাগ্যবদলের পথ তারা ধরতে পারে। কিন্তু এর বাইরে সমাজে একটা গোষ্ঠী আছে, যাদের আমরা হতদরিদ্র বলে চিহ্নিত করি। তাদের মধ্যে এ আত্মবিশ্বাস থাকে না যে তারা চেষ্টা করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সব সময় এই দিকটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনে করতেন, মানুষের ভেতরের শক্তিটি জাগিয়ে তুলতে পারলে এবং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগাতে পারলে পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। এই হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের কৌশল হচ্ছে শুরুতে এ পরিবারগুলোকে কিছু সম্পদ দেওয়া। সেটা হতে পারে গরু, জমি বা হাঁস-মুরগি।
এরপর কীভাবে তারা এ সম্পদকে কাজে লাগাবে, সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিই। প্রতি সপ্তাহে তাদের বাসায় গিয়ে পরামর্শ দেওয়া ও উদ্বুদ্ধ করার কাজটি করি। সামান্য এই সম্পদ দেওয়ার পাশাপাশি আমরা আসলে যে কাজটি করি, তা হচ্ছে নিজের সক্ষমতার ওপর আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। প্রতিবছর আমরা এ রকম ১ লাখ পরিবার নিয়ে কাজ করি এবং ২০০২ সাল থেকে আমরা তা করে আসছি। এ কর্মসূচি শুরুর আগে একটি পরিবারের অবস্থা এবং পরের অবস্থার মধ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন আমরা লক্ষ করেছি। তারা হয়তো মনে করছে যে গরু বা সম্পদ দেওয়ায় তাদের ভাগ্যের বদল ঘটেছে, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়, মূল বিষয়টি হচ্ছে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা। আমাদের কর্মসূচিটি দুই বছরের, এরপর আমরা সরে যাই। দেখা গেছে আমরা সরে যাওয়ার পরও তারা নিজের শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের জোরেই তাদের ভাগ্যের বদল অব্যাহত রেখেছে।