বাংলাদেশের আদি-ইতিহাস চর্চা ও গবেষণায় নানা অসংগতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে উজ্জ্বল অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বিশেষত প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসচর্চায় পথিকৃৎ হয়ে আছেন আহমদ হাসান দানি, আব্দুল করিম, আব্দুর রহিম, এবিএম হবিবুল্লাহ, মমতাজুর রহমান তরফদার, ইয়াকুব আলী, আব্দুল মমিন চৌধুরী প্রমুখ যারা মুদ্রা, শিলালিপি কিংবা স্থাপত্যের মতো প্রাথমিক উৎস-নির্ভর গবেষণা করে আমাদের জন্য রেখে গেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বর্তমান সময়েও সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, এ কে এম শাহনাওয়াজ, এমরান জাহান, পারভীন হাসান, শাহনাজ হোসনে জাহান, মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ প্রত্নতাত্ত্বিক-ঐতিহাসিক প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসচর্চায় অবদান রেখে চলেছেন। এ বছর বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান নামে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির যে গ্রন্থ রচনা করেছে তা আমাদের উপরোক্ত পথিকৃৎ ঐতিহাসিকদের যে গবেষণা, উদ্ভাবন ও ব্যাখ্যা তাকে ধারণ করে না। বিষয়টি এমনও নয় যে লেখকরা নিজেরাই সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক সময়ের গবেষক এবং তারা নিজেরাই গবেষণা করে সে তথ্যসমূহ বের করেছেন।
‘বখতিয়ার খলজি অনেক বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন’ এরকম অনেক অনৈতিহাসিক, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েই লিখা হয়েছে এবারের স্কুলের পাঠ্যবই। কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সোর্সই এ ধরনের বক্তব্যের সত্যতা প্রতিপাদন করে না। মনে হয়েছে, ইতিহাস নয় বরং লেখকদের কারও কারও নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায়। পাক-ভারত-বাংলাদেশ এক সময়ে ছিল বৌদ্ধ অধ্যুষিত। সেই বৌদ্ধরা কীভাবে এদেশ থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়ে গেল তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, তবে তার কোনোটাতেই বখতিয়ার খলজিকে অনেকগুলো বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয়নি। কয়েকজন নালন্দা/বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়/কিংবা ওদন্তপুরী ধ্বংসের জন্য বখতিয়ার খলজিকে দায়ী করলেও সেটাকে আবার অধিকাংশ ঐতিহাসিক নাকচ করে দিয়েছেন। কারণ, তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগগুলোর পেছনে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই, বরং বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাবকেই দায়ী বলে গবেষকরা মনে করেন।
রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী ১৯৬০-৭২ সাল পর্যন্ত পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ওপর ভিত্তি করে ‘Decline of the University of Vikramasila’ প্রবন্ধ লিখে পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন যে বখতিয়ার খলজির বাংলা অভিযানের সঙ্গে বিহার ধ্বংসের কোনো সম্পর্কই ছিল না। রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী লিপিতাত্ত্বিক (Epigraphic) ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন যে, নালন্দা/বিক্রমশীলা ধ্বংসের সঙ্গে বিজয় সেনের যুক্ততা ছিল, যিনি সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা হেমন্ত সেনের ছেলে। তাদের বসবাস ছিল বর্তমান রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার দেওপাড়া। দেওপাড়াতে প্রাপ্ত একটি লিপিসাক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনি এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ বিষয়গুলো অনেক জটিল, এবং পুরো রহস্য অনুদঘাটিত। তদুপরি এগুলোর আধুনিক বয়ানের সঙ্গে আছে উপমহাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির নানা জটিল হিসাব-নিকাশ। এরকম বিষয়সমূহ উচ্চতর অধ্যয়নের জন্য বিবেচনা করা উচিত, স্কুলের শিশু-কিশোরদের জন্য তা মোটেও উপযুক্ত নয়।