গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যে হারে ব্যাংক লুটপাট ও দখলের মহোৎসব চলছে তাতে দেশের আর্থিক ও ব্যাংক খাতে এমন বেহাল দশা সৃষ্টি হয়েছে যে, এর থেকে উত্তরণ কবে ঘটবে বলা যাচ্ছে না। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় সরাসরি লুটপাটের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তাতে দেশের মানুষের ভেতর শুধু হতাশাই তৈরি হচ্ছে না, ভয়ও সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর পর্ষদে নিয়মবহির্ভূতভাবে যোগ্য পরিচালকদের সরিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যক্তিদের বসিয়ে ব্যাংক লুটপাটের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তার বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যেই পরিলক্ষিত হয়েছে। ব্যাংকগুলোয় তারল্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষমতাবলয়ের ব্যক্তিরা একের পর এক ব্যাংক লুট করে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করে দিচ্ছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই।
গত এক দশকে বেশ কয়েকটি ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংকে অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও অর্থ লুণ্ঠন হয়েছে। এসব কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত কিছু কর্মকর্তা পর্যায়ের ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা গেলেও মূল হোতাদের আনতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত আটটি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়েছে।
এ যাবৎ যত অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঋণের নামে ৩০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি সবচেয়ে বড়। জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে ১১টি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। জামানত ছাড়া, ক্রেডিট রিপোর্ট ছাড়া, ঠিকানাহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার মানে কী দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এবং কয়েকজন পরিচালক এ বিপুল ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িত বলে অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রাথমিক পুঁজি গঠনে সবচেয়ে সহজ ও বহুলপ্রচলিত পদ্ধতি বোধহয় ক্ষমতার পৃষ্টপোষকতা নিয়ে এবং ব্যাংক পরিচালক এবং কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে জামানত ছাড়া বা ভুয়া জামানত দেখিয়ে ঋণ গ্রহণ করা এবং তারপর ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়া। বহু বছর সেই ঋণ শোধ না করে ঋণ পুনর্গঠনের নামে সুবিধা ভোগ করা। তা না হলে বড়জোর মামলা বা রিট হওয়া। এ মামলা বা রিটের বদৌলতে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া। এসব লুটেরা গোষ্ঠী ব্যাংক লুটপাটে বিভিন্ন কায়দা অবলম্বন করে থাকে। কখনো নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণপত্র খুলে, কখনো ভুয়া আমদানি-রপ্তানি হিসাব দেখিয়ে, ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ঋণের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন ব্যাংকগুলোয় জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এর বাইরে নয়। এসব জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদ বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা ব্যক্তিগত সুবিধার বিনিময়ে চিহ্নিত কিছু গোষ্ঠীকে নিয়মকানুন ও যাচাই-বাছাই না করেই এসব ঋণ অনুমোদন করে থাকেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির পেছনে সরকার গঠিত পরিচালনা পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।