কেরানীগঞ্জের রানু বেগম সৌদি আরবে ছিলেন চার বছর। গৃহকর্মী হিসেবে তাঁকে মাসে ১ হাজার রিয়েল দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে ৬০০ রিয়েল করে। তাও ৪ বছরের মধ্যে দেড় বছরই তিনি কোনো বেতন পাননি। তাঁকে পর্যাপ্ত খেতে দেওয়া হতো না। তাঁর কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা ছিল না, তিনি পর্যাপ্ত বিশ্রামের সময় পেতেন না, রাত তিনটায় ঘুমিয়ে ভোর পাঁচটায়ও উঠতে হয়েছে।
কুমিল্লার মিজানুর রহমান দুবাইতে কাজ করেছেন ১১ বছর। কিন্তু চাকরির মেয়াদ শেষে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা, ইনস্যুরেন্স কিংবা ব্যাংক গ্যারান্টির টাকা নিয়ে ফিরতে পারেননি।
কেরানীগঞ্জের ওমর আলী একজন দক্ষ শ্রমিক হিসেবে আসবাবের দোকানে কাজ করতে গিয়েছিলেন লেবাননে। ৪৫ হাজার টাকা বেতনের কথা বলে তাঁকে বেতন দেওয়া হতো ২৭ হাজার টাকা। চুক্তির সময় খাওয়া ও চিকিৎসার খরচ মালিকপক্ষের বহন করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হতো না।
টাঙ্গাইলের নাজির হোসেন সৌদি আরবে গিয়েছিলেন ২০২২ সালের মে মাসে। অফিস ক্লিনারের কথা বলে তাঁকে কাজ করানো হয়েছে হোটেলে। সেখানে তাঁকে দৈনিক ১৮/১৯ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। এভাবে চার মাস কাজ করিয়েও তাঁকে কোনো আকামা দেওয়া হয়নি, অবশেষে দেশ থেকে ধার করে টাকা নিয়ে তাঁকে ফিরে আসতে হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের মোহাম্মদ সজীব লেবাননে গিয়েছিলেন ২০১৯ সালে। সেখানে তিনি ৯ মাস কাজ করেছেন। চুক্তিতে ৪০০ ডলার থাকলেও তাঁকে দেওয়া হয়েছে মাসে ২০০ ডলার। যাওয়ার জন্য তাঁর খরচ হয়েছিল সাড়ে চার লাখ টাকা। তাঁর থাকা–খাওয়ার খরচ আবার বেতন থেকে কেটে নেওয়া হতো। এভাবে তিন বছর কাজ করার পর বাধ্য হয়ে তিনি অন্যত্র কাজ খুঁজতে গিয়ে ‘অবৈধ’ হয়ে যান।
বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের এভাবে প্রতারিত ও বঞ্চিত হওয়ার ঘটনাগুলো জানা গেল অভিবাসী শ্রমিকদের এক গণসাক্ষ্য থেকে। ২২ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে জাতীয় প্রেসক্লাবে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) ও মাইগ্রেন্ট ফোরাম ইন এশিয়া যৌথভাবে অভিবাসী শ্রমিকদের ‘মজুরি চুরিবিষয়ক’ এক গণসাক্ষ্যের আয়োজন করে। ঢাকার কেরানীগঞ্জ, কুমিল্লা ও টাঙ্গাইলের প্রবাসফেরত শ্রমিকদের নানাভাবে মজুরিচুরির শিকার হওয়ার এসব অভিজ্ঞতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। করোনাকালে পাওনা না নিয়েই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের অভিযোগ থেকে বিষয়টি সামনে এলেও মজুরিচুরির সমস্যাটা শুধু করোনাকালের নয়; এটি বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটা কাঠামোগত সমস্যা। এ কারণে অভিবাসী অধিকারকর্মীরা এসব প্রবণতাকে ‘কাঠামোগত মজুরি চুরি’ হিসেবে অভিহিত করছেন।