অপার সম্ভাবনার ঢাকা অনাবাসযোগ্য
‘মানবসভ্যতার ইতিহাসে নগর একটি বিস্ময়’—এ চিন্তাধারা অধ্যাপক নজরুলকে তার কাজকর্মে তাড়িত করেছে যা ঢাকা নিয়ে তার আশা-নিরাশায় বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রাদেশিক রাজধানী থেকে দেশের রাজধানী, নগর থেকে মহানগর এবং তাও পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম—ঢাকার এ রূপান্তরের গৌরবের সঙ্গে অনাবাসযোগ্য পরিচিতি অধ্যাপক নজরুলকে বিচলিত করে। অধ্যাপক নজরুল অপ্রীতিকর বা কঠিন কথা বলার মানুষ নন। তাই তিনি যখন লেখেন, ‘অব্যবস্থা, উদাসীনতা, অযোগ্যতা এবং দুর্নীতির ফলে রাজধানীর এ অবস্থা হয়েছে’ তখন উপলব্ধি করা যায় ঢাকা নিয়ে তার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বর্তমান অবস্থার ফারাক কতটা। তার আকাঙ্ক্ষায় ঢাকা হবে ‘একটি সুন্দর সমৃদ্ধ রাজধানী শহর। এমন একটি শহর যেখানে সর্বক্ষেত্রে দক্ষতা থাকবে, সৌন্দর্য থাকবে, প্রবৃদ্ধি থাকবে, সমতা থাকবে, পরিবেশ ভারসাম্য বজায় থাকবে, স্বাস্থ্যসম্মত হবে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অটুট থাকবে, গণতান্ত্রিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে’। এ প্রসঙ্গে আরো একটি গভীর উপলব্ধির কথা তিনি স্পষ্ট করেন অনাবাসযোগ্য তো নয়ই—‘অসাম্যের রাজধানীও কখনই সুন্দর রাজধানী হবে না’।
তিনি মন্তব্য করেন, ঢাকার বর্তমান অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি, বহু বছরের অবহেলা, অদক্ষতা, অপরিণামদর্শিতা, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, সদিচ্ছার অভাব, যথাযথ নেতৃত্বের অভাবে আজকের ঢাকার অনাবাসযোগ্য পরিচিতি। এ পরিচিতিকে অস্বীকার না করে তিনি দৃষ্টিতে আনেন বসবাসের অনুপযোগী নির্ণয়ের সমীক্ষায় যে পাঁচটি বিষয় বিবেচনা করা হয় তার প্রতি। এগুলো হলো: স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা, অবকাঠামো। ঢাকার সবচেয়ে খারাপ স্কোর অবকাঠামোতে (২৬.৮/১০০)। অধ্যাপক নজরুল মনে করেন, ঢাকার অনাবাসযোগ্য পরিচিতি যে বিবেচনায় হলো তার দৃশ্যত কারণ অবশ্যই অবকাঠামো। যার মধ্যে রয়েছে পরিবহন, রাস্তাঘাট, পানি, বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশন, জ্বালানি, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, পার্ক, গাছপালা।
ঢাকার বহুল সমস্যা উপলব্ধি ও সমাধানের জন্য প্রথমেই বিবেচনায় আনতে হবে এর বিশালতা ও গুরুত্ব। দেশের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ৪০০ বছরে গড়ে ওঠা ঢাকা জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের এ ৫০ বছরের মাথায় যে ঢাকায় রূপান্তরিত হয়েছে তার আকারে রয়েছে ঢাকার দুটি করপোরেশনসহ সাতটি পৌরসভা। ঢাকার দুটির সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ, কদম রসুল, টঙ্গী, গাজীপুর ও সাভারে বিস্তৃত হয়ে গঠিত হয়েছে আজকের মহানগর ঢাকা, যার সীমানা ১ হাজার ৫৩০ বর্গকিলোমিটার (রাজউকের সীমানা) ও লোকসংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। কিন্তু কেন্দ্রীয় শহর মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটার বা আরো কম (লোকসংখ্যা ৭০-৭৫ লাখ)। এ বিশাল নগরবাসীর ৪০ শতাংশের অধিক দারিদ্র্যসীমার নিচে, খুবই দরিদ্র ২০%-২৫% ও ৩০% বস্তিতে (নজরুল ইসলামের ‘ঢাকা মহানগরীর উন্নয়ন’, ২০১৪, পৃ ৩০৫) যা এরই মধ্যে বৃদ্ধি পেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম চিহ্নিত ঢাকার সমস্যার কারণের মধ্যে রয়েছে: জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার, কর্মসংস্থান সমস্যা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ব্যাপক দারিদ্র্য, পরিবহন সমস্যা, আবাসন সমস্যা, পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, জলাবদ্ধতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশ বিপন্নতা ও দূষণ সমস্যা, আইন-শৃঙ্খলা ও সামাজিক নিরাপত্তা সমস্যা। ‘খালগুলো দখল হয়ে গেছে’ কথাটা বারবার আসে তার লেখায় বিশেষ করে জলাবদ্ধতা সমস্যা প্রসঙ্গে। খাল গেছে বেদখল হয়ে আর বুড়িগঙ্গা শেষ হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়ন ও ঠুনকো শিল্পায়নে। কেন এ রকম হলো? তিনি বিভিন্নভাবে তা প্রকাশ করেছেন: ‘অব্যবস্থা, উদাসীনতা, অযোগ্যতা এবং দুর্নীতির ফলে রাজধানীর এ অবস্থা হয়েছে’; ‘নগর কর্তৃপক্ষের ও বিভিন্ন সংস্থার উদাসীনতার কারণে ঢাকার বর্তমান অবস্থা’; ‘বহু বছরের বহু দশকের অমনোযোগের কারণে, অবহেলার কারণে, অপরিকল্পনার কারণে’; ‘সত্যিকার গরজ নেই, প্রচেষ্টাও নেই’; ‘মহানগরের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার সম্পৃক্ত সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব’; ‘সম্পদের সীমাবদ্ধতা, সার্বিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং নাগরিক সচেতনতার ঘাটতি’। ‘পূর্ব ঢাকার প্রান্ত দিয়ে বালু নদীর পাড় দিয়ে পূর্ব ঢাকা বাইপাস সড়ক ও বন্যারক্ষা বাঁধ নির্মাণ’ তার নতুন উদ্বেগ।