অতি সম্প্রতি বেশ আলোচিত বিষয় হিসেবে এসেছে পাবনায় ১২ জন কৃষকের ঋণখেলাপি হিসেবে কারাবাস এবং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দ্রুতই জামিনে মুক্তি। বিষয়টি পত্রপত্রিকায় এমনভাবে এসেছে; সরকারপ্রধান বিষয়টি উপেক্ষা করতে পারেননি। এদিকে উচ্চ আদালতও দুদকের আইনজীবীকে প্রশ্ন করছেন- চুনোপুঁটিদের আপনারা ধরছেন, কিন্তু বড়দের কিছু বলছেন না! ওদিকে কারাবাস করা ১২ জনসহ মোট ৩৭ কৃষকের জামিন মঞ্জুর হওয়ার পরও তাঁদের উদ্বেগ কাটছে না। তাঁরা সবাই জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
এই চিত্র শুধু ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে নয়। ব্যাংকগুলো নিম্নমূল্যে সুদ দিয়ে থাকে ক্ষুদ্রঋণের বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। তারা অল্প সুদে টাকা নিয়ে কৃষক খুঁজে ব্যবসায়ী ও নারী উদোক্তাদের মধ্যে উচ্চ সুদে ঋণ বিতরণ করে থাকে। বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই ঋণের জন্য কোনো আমানত দিতে হতো না এবং উদ্দেশ্য দারিদ্র্য বিমোচন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ঋণ নারীদের দেওয়া হতো। ঋণের টাকা পেয়ে ওই নারী বাড়ি পৌঁছানোর আগেই স্বামী তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইচ্ছামতো খরচ করে ফেলেছেন। সে অর্থ কোনো উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার না হওয়ায় ওই নারী ঋণখেলাপি হয়ে গেছেন। দেখা যেত অন্য একটি সংস্থা পুনরায় তাঁকে ঋণ দিল এবং সেই টাকাটাও নিঃশেষ হয়ে গেল। ফলে দারিদ্র্য তো কমলই না, বরং বিষয়টি এমন পর্যায়ে চলে গেল; কিছু ক্ষেত্রে ওইসব ব্যক্তি ঋণখেলাপি হয়ে ঋণ পরিশোধের চাপে এমনকি আত্মহননের পথ খুঁজে নিলেন।
বাস্তবে বহু সমীক্ষায় এটা প্রমাণিত, দরিদ্র মানুষই একমাত্র ঋণের টাকা ফেরত দেয়। কৃষকেরও ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি কখনও অর্থ পাচার করেন না। বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন না। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে কৃষি উৎপাদন করে দেশ ও সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখেন। অন্যদিকে ঋণ বিতরণকারী সংস্থা বা ব্যাংকগুলো বিপুল মুনাফা করে ঢাকা শহরে বহু তলবিশিষ্ট অট্টালিকা নির্মাণ করে বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করে এবং অনেক ক্ষেত্রে অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। ঋণ ব্যবস্থাটি নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার মাঝেমধ্যে নানা নির্দেশ জারি করে থাকে। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না।
আবার কৃষকের সমস্যা নানাবিধ। একে তো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল উৎপাদন ব্যাহত; দুই ফড়িয়া ও চাঁদাবাজদের হাতে পড়ে কোনোভাবেই তাঁর পণ্যের দাম পান না। প্রতিবছর দেখা যায়, ক্ষুব্ধ কৃষক হাটে গিয়ে পণ্য বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিয়ে চলে আসেন। কখনও তাঁর পণ্যে আগুন ধরিয়ে দেন। সরকার নিজে কৃষিপণ্য ক্রয় করে, কিন্তু সেখানেও কয়েক হাত পার হওয়ার পর। প্রকারান্তরে কৃষক সাধারণত নিঃস্ব হয়ে ঘরে ফেরেন। ফলে কৃষি বর্তমানে অনেক কৃষকের কাছে আদর্শ পেশা নয়।
ঢাকা শহরে ক্রমবর্ধমান হারে যেসব রিকশাচালকের আগমন ঘটছে, তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত দেখলেই বোঝা যায়; কৃষি থেকে তাঁরা উৎখাত হয়ে একেবারেই নিজের প্রাণ ধারণের প্রয়োজনে শহরে চলে এসেছেন। এর মধ্যে আছে প্রবল বেকারত্ব। রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানার শ্রমিকরা কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে গ্রামাঞ্চলে চাষাবাদ করার চেষ্টা করেছেন। টাউট-বাটপারদের পাল্লায় পড়ে তাঁরা উৎখাত হয়ে শহরে চলে আসেন।