বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি ছিল। দেশের ভেতরে যেমন দেশের বাইরেও তেমন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশের বাইরে অকৃত্রিম বন্ধু ছিল ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো, ভিয়েতনাম, কিউবা। আমেরিকা, চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো প্রায় সবাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের পক্ষে। স্বাধীনতার পর, বিশেষ করে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পালাবদল হয়েছে এবং বিশ্ব পরিস্থিতিও আগের জায়গায় নেই।
সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব আর নেই। এখন একাত্তরের শত্রু দেশগুলোর সঙ্গেও বাংলাদেশের বৈরিতা নেই। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে উষ্ণতার ওঠানামা আছে। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে উষ্ণতা বাড়ে, অন্য সরকার এলে কিছুটা হেরফের হয়ই। তবে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আর বৈরী নেই। বরং অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে চীন সম্ভবত এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য চোখে পড়ার মতো।
ভারতের সঙ্গে আগে থেকে চলে আসা অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে। কিছু সমস্যা এখনো আছে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বহু বছর ধরে ঝুলে আছে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি অস্বস্তির কারণ। তিস্তার পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকার চাষাবাদে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চীনের সহযোগিতায় তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রকল্প নামে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের করা একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের আগ্রহ আছে। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন শেষে জানিয়ছিলেন, চীন ৮ হাজার ২শ কোটি টাকা ঋণ দিতেও প্রস্তুত।
এ প্রকল্প নিয়ে কারও কারও মধ্যে আগ্রহ তৈরি হলেও ৭ নভেম্বর ভোরের কাগজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ভূরাজনৈতিক চাপের কারণে সমন্বিত তিস্তা প্রকল্প থেকে সরে আসতে হচ্ছে সরকারকে। চীনের সাহায্য নিয়ে তিস্তা প্রকল্পে ভারতের আপত্তি আছে বলেই বিষয়টি ঝুলে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্তত আগামী নির্বাচনের আগে ভারতের জন্য ‘স্পর্শকাতর’ কোনো বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার হয়তো মনোমালিন্য হওয়ার মতো কিছু করতে চায় না।
তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পটি চীন শ্রমিকনির্ভর প্রকল্প হিসেবে সাজিয়েছে। এই কাজের জন্য শ্রমিক, প্রকৌশলীসহ আড়াই তিন হাজার চীনা নাগরিক নিয়োজিত হবেন। যেখানে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে তার থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে ভারত সীমান্ত। এই ভূখণ্ডের আকৃতি মুরগির ঘাড়ের মতো হওয়ায় একে বলা হয় ‘চিকেন’স নেক’। এর পূর্ব দিকে নেপাল, পশ্চিমে বাংলাদেশ। মাঝখানে খুব সংকীর্ণ একটি অংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে। এই এলাকাটি ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্নে খুবই স্পর্শকাতর।