কলকাতা ছাড়িয়ে ঢাকায় পা দিলেই আমরা দেখতে পাই কেরানিদের অন্যরূপ। ঢাকার কমলাপুরে কেরানিবহনের জন্য মিনিটে মিনিটে রেল পরিষেবা নেই। মেট্রো আগামী দিনের স্বপ্ন। ঢাকায় রয়েছে পিঁপড়ের ঝাঁকের মতো নানা মডেলের বাস পরিষেবা। অফিস শুরু আর শেষ বেলায় পরিবহনের কারণে রাস্তাঘাটের মাটির তল খুঁজে পাওয়া যায় না। হর্ন বাজার বিচিত্র শব্দে আকাশ চির ধরে। শব্দদূষণের এ যেন ভিন্ন দুনিয়া। মফস্বল থেকে নগরীতে প্রবেশ মুখে দেখা যায় যানজটে পড়া বাস নয় তো হাজার-লক্ষ হিংস্র ক্ষুধার্ত অরণ্যচারীরা ঘিরে আছে আস্তো নগর। এই নগর প্রবেশকারীরা কারা? কেবল কি সাধারণ যাত্রী? শ্রমিক? এদের একটা অংশ সরকারি কর্মীবাহিনী, বেসরকারি অফিসের কলম আর কম্পিউটার টেপা কেরানি। কোথা থেকে নগরে প্রবেশ করে ওরা? অদূরবর্তী মিরপুর-দূরবর্তী ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী, উত্তরা, টঙ্গী, গাজীপুর, রূপগঞ্জ, কালীগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে ওদের ঘর-গেরস্থালি। এদের একটা অংশ দূর জেলার স্থায়ী বাসিন্দা। মূল শহর তাদের স্বপ্ন মাত্র। তাই ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে সস্তায় বাড়িভাড়া কিংবা দু-চার কাঠা জমি-জিরেত কিনে ওরা আধাপাকা ঘর তোলে। যেন উইপোকার জীবন। দিন যায়। রাত নামে।
কলকাতার নিত্যযাত্রী অফিসকর্মী বা কেরানিদের জীবন বড় বিচিত্র। মগজের ভেতর কিলবিল করে ঈশ্বরের দান একটি চাকরি এবং স্বপ্নের সংসার। চাকরির প্রতীক্ষায় হারাতে বসে যৌবন। অবসাদ-বিষণ্নতায় ঘটে আত্মহত্যা। মাত্র একটা চাকরি। ভাগ্যের চাকা ঘুরলে চাকরি হয়। তখন চলে দেবতার কাছে মানতের ঋণশোধ। চাকরি হলেই স্বপ্নে জাগে একটি নারী, স্ত্রী পদবির নারী আর অনাগত সন্তানের কল্পনা। অপার সুখ, অন্তহীন শান্তি ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় মনের ভেতর। এখানে বৈবাহিক জীবনের সঙ্গে চাকরিপ্রাপ্তির এক জটিল খেলা চলে। স্ত্রী নামক নারীর সঙ্গে একজন দীর্ঘ বেকার জীবনের যন্ত্রণা ভোগা যুবকের সংযোগ ঘটলেই চিরদিনের বাবা-মায়ের সংসার আর বাবা-মা, ভাই-বোন নামের প্রিয় মানুষ আর সম্পর্কগুলোতে ভাঙনের প্রতিধ্বনি ওঠে। সমাজ আর রাষ্ট্রের বলে দেওয়া ‘মাইক্রো ফ্যামিলি’ হাতছানি দেয়। সেই মাইক্রো ফ্যামিলির অধীশ্বরী স্ত্রী রাত তিনটের ঘুম ভেঙে তৈরি করে ভাত, তরকারি, সবজি এবং অতিরিক্ত প্রোটিনের জন্য সেদ্ধ ডিমের অর্ধেক টিফিন ক্যারিয়ারে ঢুকিয়ে দিয়ে পুনরায় ঘুমোতে যায়। ভোর পৌনে পাঁচটার লোকালে চেপে শহর কলকাতা যাবে বলে ছুটতে থাকে স্টেশনের উদ্দেশ্যে। যেতে হবে ধর্মতলা কিংবা নবাব রফী আহমেদ কিদোয়াই রোড। দিনান্তের ট্রেনে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে ঘরে ফেরে কেরানি। শরীর না-তো লাশ। সার্ট-প্যান্টে ঘামের গন্ধ নয় তো মর্গের লাশের গন্ধ।