ডিসিনির্ভর (দ্বৈত নাগরিকত্ব) ব্যবস্থার ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। সাধারণত দক্ষিণ ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা উত্তর গোলার্ধের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরির ক্ষেত্রে ডিসিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে তাদের অংশগ্রহণ (যৌক্তিক হলেও) দক্ষিণে প্রতিষ্ঠান তৈরিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং সম্পদের বহিঃপ্রবাহকে উৎসাহিত করে। সংকটকালে এ প্রভাব অধিকমাত্রায় অনুভূত হয় এবং সে সময়ে দুর্দশার মাত্রা ততোধিক। একটি দেশ থেকে আরেকটি দেশে অভিগমনের সঙ্গে অন্তর্নিহিতভাবে একটি দেশের অভ্যন্তরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় (গ্রাম থেকে শহর) অভিগমনের কোনো তফাত নেই। নগরকেন্দ্রে অভিবাসিত হওয়া মানুষজন গ্রামে (কিংবা ছোট শহরের) উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি বিক্রি করে দেয় এবং নিজেদের সন্তানদের লালন-পালনের জন্য শহরে অর্থটা নিয়ে আসে। একইভাবে গ্রামের সচ্ছল পরিবারের অনেকেই সন্তানদের শিক্ষার জন্য শহর এলাকায় পাঠায়, যাদের অনেকেই আর গ্রামে ফেরে না। অবশ্য লোভনীয় বিনিয়োগ, যেমন ঠিকাদারি ব্যবসা, মাছ চাষ, গরুর খামার, রিসোর্ট প্রভৃতির জন্য এদের অনেকে শিকড়ে ফিরে আসে। তারা সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে অর্থ ব্যয় করে এবং জনহিতকার কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করে। সীমান্ত পেরিয়ে দুদেশের মধ্যে যখন এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটে, তখন তার বাড়তি প্রভাব থাকে, বিশেষ করে আর্থিক বাজারের ক্ষেত্রে। আন্তঃদেশীয় আর্থিক ও মানবসম্পদ প্রবাহ (চলাচলে) উভয় উৎস দেশ এবং গন্তব্য দেশে বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মুখোমুখি হয় এবং তুলনামূলকভাবে অধিক শক্তিশালী দেশটি নিয়মনীতিগুলো প্রভাবিত করতে পারে। স্বভাবতই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ক্ষমতাশালী দেশের স্বার্থ আন্তঃদেশীয় অর্থ বা সম্পদপ্রবাহের দিক এবং পরিমাণ নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে টাকা বা ডলারের দামের ওঠানামার সনাতনী বিশ্লেষণে আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে ডলার (বৈদেশিক মুদ্রার) চাহিদা এবং রফতানি আয় ও এনআরবিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের সঙ্গে ডলারের জোগানকে সম্পর্কিত করি। নিবন্ধিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা বাদ দিয়ে খুব সংকীর্ণ পরিসরে দেখলে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার অন্যান্য কারণের মাঝে রয়েছে পর্যটন, বিদেশে চিকিৎসা, বিদেশী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ইত্যাদি। এছাড়া ঋণ নিলে বা বৈদেশিক বিনিয়োগ এলে ডলারের জোগান যেমন বাড়ে, ঋণ পরিশোধ বা বিদেশী বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা বাইরে প্রেরণকালে ডলারের চাহিদা বাড়ে। এসবের বাইরে আইনি ও বেআইনি পথে অর্থপ্রবাহের দুটো উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, ব্যাংক সুদে আকৃষ্ট হয়ে অর্থপ্রবাহ এবং সম্পদ ক্রয় বা বিক্রয় করে অর্থের দেশান্তর। প্রতিটি চাহিদা বা জোগানের সঙ্গে আমরা নির্দিষ্ট ক্রীড়ক চিহ্নিত করি। যেমন আমদানিকারক, রফতানিকারক বা বিদেশে কর্মরত ব্যক্তি। আমি প্রস্তাব রাখছি, ডিসি নামক ক্রীড়ককে অন্তর্ভুক্ত করলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা (ডলার) বাজার বিশ্লেষণ অধিকতর উপযোগী হবে।
সবাই কমবেশি স্বীকার করেন যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আমদানি ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে (২০২২-এর জুনে) আকস্মিক আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণ স্পষ্ট নয়। আমদানিকালে অধিক মূল্যায়নের (ওভার ইনভয়েসিংয়ের) মাধ্যমে অর্থ পাচারের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছিল বলে অনেকে দাবি করেন। তবে এটাও সম্ভব যে ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতির শঙ্কায় ইনভেন্টরি গড়ে তোলার জন্য অধিক আমদানি করা হয়ে থাকতে পারে। দুটোর পরিণতি ভিন্ন প্রকৃতির। আমদানি, রফতানি ও রেমিট্যান্সের গতিপ্রকৃতি সামষ্টিকভাবে অনুধাবনযোগ্য। সে তুলনায় অন্যান্য ব্যক্তি খাতের নিট (ডলার) চাহিদা অনেক বেশি অনিশ্চিত। তবে ডিসি নামক ক্রীড়ক অন্তর্ভুক্ত করলে তা অনেকাংশে অনুধাবন ও অনিশ্চয়তার মাত্রা হ্রাস সম্ভব এবং কার্যকর নীতির ভিন্ন একটি দিকের প্রতি নজর দেয়া সম্ভব।