১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বরের প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। কারাগারের ভেতরে এমন পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল।
আমার স্মৃতির পাতায় জেলহত্যা এক বেদনাবিধুর ঘটনা। আমার বাবা এ এইচ এম কামারুজ্জামান যেদিন শহীদ হলেন, আমি ও আমার ছোট ভাই স্বপন তখন কলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করছি। বাবার মৃতদেহ দেখার কোনো সুযোগ আমরা পাইনি।
বাবা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এক অতন্দ্র সৈনিক। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তাঁর জীবনভাবনার মূল সোপান ছিল। সারা জীবন তিনি সেই আদর্শে অবিচল ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা হিসেবে আপস করেননি ১৫ আগস্টের হত্যাকারী খুনি চক্রের সঙ্গে। শুধু আমার বাবা নন, জাতীয় অন্য তিন নেতাও ছিলেন একই রকমের ইস্পাতসম মনোবলের অধিকারী।
মায়ের কাছে শুনেছি, সেই রাতে একটা জলপাই রঙের জিপ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর লাফিয়ে নামে কালো পোশাক পরা কয়েকজন অস্ত্রধারী। কারারক্ষীদের গেট খোলার নির্দেশ দেয় তারা। ‘ওপরের’ নির্দেশ ছাড়া কারারক্ষীরা গেট খুলবেন না। তখন বঙ্গভবনে ফোন করে অস্ত্রধারীরা। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে যে নির্দেশ এসেছিল, সেটা আমাদের সবারই জানা। বঙ্গভবনের নির্দেশ পেয়ে গেট খুলে দিলেন কারারক্ষীরা। ভেতরে ঢুকে জাতীয় চার নেতা—তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে ১ নম্বর সেলে একসঙ্গে জড়ো করার আদেশ দেওয়া হলো। চারজনকে একত্র করার পর খুনি মোসলেম বাহিনী ব্রাশফায়ারে নিভিয়ে দিল জাতির সূর্যসন্তানদের জীবন প্রদীপ। সেকেন্ডের ব্যবধানে হারিয়ে গেল বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম চার নেতার প্রাণস্পন্দন।
বিশ্বাস করি, দেশের ও ইতিহাসের সঙ্গে যাঁদের নিবিড় সম্পর্ক, সেই গুণী মানুষগুলো হারিয়ে গেলেও হারায়নি তাঁদের অমর কৃতিত্ব ও অবদান। তাঁরা গণমানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়েছিলেন বলেই তাঁদের সন্তান হিসেবে আমরা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি।