সম্বোধন আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্বোধন শুনে বোঝা যায় মানুষে মানুষে সম্পর্ক, সামাজিক অবস্থান ও শ্রেণিবৈষম্য। বাংলা ভাষায় তিনটি সম্বোধন পদ আছে : তুই, তুমি ও আপনি। তুচ্ছার্থে বা নিচু শ্রেণি বোঝাতে যেমন ‘তুই’ বলা হয় তেমনি অতি প্রিয়জনকে ভালোবেসে বা আদর করে ‘তুই’ সম্বোধন করা হয়। এটা আমাদের ভাষার মাধুর্য, রেওয়াজ বা প্রচলিত রীতি। আমরা ছোটদের ‘তুই’ বা ‘তুমি’ আর বড়দের ‘আপনি’ বলি। এই আমরাই আবার শ্রেণি বিবেচনায় বাবা-মা-দাদা-নানার বয়সী মানুষকেও তুই-তোকারি করি দম্ভ ভরে। যুগ যুগ ধরে সামাজিক অবস্থান বা পোশাক দেখে খুব সহজেই তুই-তোকারির প্রথা রয়েছে। বাসাবাড়িতে কাজের বুয়াকে ৫-৬ বছরের শিশুও ‘তুই’-‘তুমি’ বলে ডাকে। আর বয়স্ক বুয়ারা ‘ভাইয়া’, ‘আপামণি’ বলে ডাকে। রিকশাওয়ালা ফেরিওয়ালা বা নিম্নবিত্তের মানুষদের অবলীলায় ‘তুই-তোকারি’ করাটাই এখানকার নিয়ম। এই ঘটনাগুলো আমাদের কাছে অতি পরিচিত।
এ ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা নিরাপদ। সেখানে সবাই ‘ইউ’ অর্থাৎ তুমি। ‘আপনি’ বা ‘তুই’ এর বালাই নেই। আমাদের পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘তুই’ সম্বোধনটাই বেশি চলে। তারা ছোটদের ‘তুই’ বলে ডাকে। এক টিভি সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মোহাম্মদ বলেন, ‘বিশ্বভারতীতে (শান্তিনিকেতন) পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রথমে আমার খুব সমস্যা হয়েছিল। সেখানে সব শিক্ষকরা তুই বলে ডাকেন। আমি সেটা মেনে নিতে পারতাম না। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়েছি। আসলে তুই বলে ডাকাটাই সেখানকার চল’। চলচ্চিত্রনির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘এবং ঋতুপর্ণ’ নামে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ছোট-বড় প্রায় সবাইকে তুই সম্বোধন করতেন। একবার ঋতুপর্ণ ঘোষকে কোনো এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সবাইকে তুই বলার কারণ। তিনি বলেছিলেন, ‘তুই বললে একে অন্যকে কাছের আর বেশি আপন মনে হয়। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অন্তরঙ্গ হওয়া সহজ হয়।’ ৭০-৮০’র দশকে বন্ধু-বান্ধবীরা তুই বলেই সম্বোধন করত বেশি। ’৯০ দশক থেকে বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে তুমি বলার চল বেড়েছে। বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে বিয়ে হলে তুই থেকে তারা তুমি বা আপনি সম্বোধনে চলে যেতেন। কারণ বিয়ের পর তুই-তোকারি চলে না। সহপাঠীরা একে অপরকে তুই বলে ডাকলেও উভয়ের মধ্যে পরিণয় ঘটলে তখন এক অজানা নির্দেশে ‘তুই’ শব্দটি তুমিতে উন্নীত হয়। বিয়ের পর তুই সম্বোধন তাদের কাছে যেন বেমানান লাগে। দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্কে সম্বোধনটি তুমি হলেই যেন ভালো। এক সময় আমাদের দেশে স্বামীরা স্ত্রীদের সম্মান করে আপনি বলে ডাকতেন। আবার তুই বলে ডাকার চলও আছে। স্ত্রীকে আপনি বলবেন এটা অনেক পুরুষ যেন ভাবতেই পারেন না। তবে, ইদানীং অনেকেই স্ত্রীকে তুমির পরিবর্তে তুই বা আপনি বলে ডাকছেন ভালোবেসে।