মিঠাপানির ডলফিন একটি অতিবিপন্ন প্রাণী। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘গঙ্গাজ রিভার ডলফিন’। ১৯৯৬ সাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকাভুক্ত দূষণমুক্ত পরিষ্কার পানিতে বিচরণকারী এসব ডলফিন স্থানীয়ভাবে উতোম বা শুশুক নামে পরিচিত। দেশের অন্যতম মিঠাপানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে বালুবাহী নৌকা ও ড্রেজারের প্রপেলরের আঘাত, দূষণ ও নিষিদ্ধ জালে আটকা পড়াসহ নানা কারণে প্রতিনিয়তই এ ডলফিনের মৃত্যু বেড়েছে। যদিও বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন অনুসারে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। ডলফিন হত্যা, বিক্রি ও খাওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। তারপরও হালদা নদীতে একের পর এক মারা পড়ছে ডলফিন।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ বছরে মোট ৩৯টি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে। এগুলোর দুয়েকটি বাদ দিলে প্রায় সব মরা ডলফিনের শরীরে আঘাতের চিহ্ন শনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। একাধিক ডলফিন হত্যাও করা হয়েছিল। চলতি বছর জুলাইয়ে ৮ দিনের ব্যবধানে তিনটি মৃত ডলফিন ভেসে উঠেছে হালদা নদী ও সংলগ্ন খালে। ২১ জুলাই নদীর রাউজানের গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাট এলাকায় সর্বশেষ মৃত ডলফিনটি পাওয়া যায়। এর আগে ২০ জুলাই আজিমের ঘাট এলাকায় আরেকটি বড় আকারের মৃত ডলফিন ভেসে আসে। ডলফিনটির ঠোঁটের নিচের অংশ বিচ্ছিন্ন ছিল। দাঁতগুলোও ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ডলফিনটির মুখ জালে আটকা পড়েছিল। তাই ছাড়িয়ে নিতে এভাবে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ১৪ জুলাই রাউজানের দক্ষিণ গহিরা এলাকায় হালদার সংযোগ খাল বুড়িসর্তা থেকে প্রায় সাড়ে ৮ ফুট দৈর্ঘ্যরে ১২০ কেজি ওজনের এ যাবৎকালে সবচেয়ে বড় একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়। এসব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নদী ও জলজ প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডলফিন রক্ষায় এখন পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এছাড়া প্রশাসনের মনিটরিং কমে যাওয়ায় অবৈধ জাল ফেলার প্রবণতা বেড়ে গেছে, যা বিপন্ন প্রজাতির এ ডলফিনের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে হালদা নদী থেকে ডলফিন বিলুপ্ত হতে পারে। তাই বিলুপ্তির হাত থেকে ডলফিন রক্ষায় পরিবেশ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, নদী ও জলজ প্রাণী বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় জনগণকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, হালদা নদীতে যে ডলফিনের দেখা মেলে তা গাঙ্গেয় ডলফিন। এ ডলফিন বিশ্বের বিভিন্ন নদীতে আছে মাত্র ১ হাজার ১০০টি। এর মধ্যে শুধু হালদায় ছিল ১৭০টি। সূত্র জানায়, চলতি বছর হালদা নদীতে পরিচালিত জরিপে ১৪৭টির মতো ডলফিন মিলেছিল। ২০২০ সালে জরিপে মিলেছিল ১২৭টি। উদ্বেগজনক হলেও সত্যি, মাত্র পাঁচ বছরে ৩৯টি ডলফিনের মৃত্যু এদের শঙ্কার মুখে ঠেলে দিচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, ডলফিনগুলো রক্ষা করা না গেলে হালদা ডলফিনশূন্য হয়ে যাবে। ডলফিন বাঁচাতে নদী তীরের বাসিন্দাদের সচেতনতাই একমাত্র পথ।