পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে, এবং অত্যাচারে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিসঞ্চয় ঘটছিল। একসময়ে যারা মুসলিম লীগের হয়ে স্বতন্ত্র মুসলিম জাতীয়তাবাদের পক্ষে কাজ করেছেন, তাদেরই একাংশ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। এদের কেউ কেউ ইসলামি সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু কেউই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পর্যন্ত অগ্রসর হননি। প্রকারান্তে তাদের অধিকাংশই কমিউনিস্টবিরোধী ছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় দুটি সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে। উৎসাহী তরুণরাই গঠন করেছিলেন। একটির চরিত্র ছিল আধা-সাংস্কৃতিক, অপরটি ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল পরস্পরবিরোধী। সাতচল্লিশের ১ সেপ্টেম্বরেই আত্মপ্রকাশ ঘটে পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের, এবং এর পরপরই, ৬ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় গণতান্ত্রিক যুবলীগ। তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকায় এক ধরনের আপাত প্রগতিশীলতা ছিল। তারা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করার পক্ষে বই বের করেছেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়। সে-সময়ে তারা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছেন, নাম দিয়েছেন সৈনিক; তাদের মাসিক পত্রিকার নাম ছিল দ্যুতি। তবে তারা দ্বিজাতি তত্ত্বে, অর্থাৎ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে, বিশ্বাস করতেন, এবং পরে তারা যে রাজনৈতিক দল গঠন করেন সেটির নাম ছিল খেলাফতে রব্বানী পার্টি। সাংগঠনিক কাজের ব্যাপারে তমদ্দুন মজলিস কমিউনিস্ট পার্টিকে অনুসরণ করত। দৃষ্টি ছিল সার্বক্ষণিক কর্মী তৈরির দিকে। সমাজতন্ত্রের কথাও তারা বলত। কিন্তু তাদের সংগঠন ছিল পুরোপুরি কমিউনিস্টবিরোধী; তারা চাইত ইসলামি সমাজতন্ত্র, এবং ভয় পেত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজটা কমিউনিস্টরা না নিয়ে নেয়। তমদ্দুন মজলিস বেশ কিছুদিন জীবন্ত ছিল, তাদের কর্মী সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছিল; কিন্তু দ্বি-জাতিতত্ত্বের সাংস্কৃতিক বলয়ের বাইরে গিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করতে না পারায় সংগঠনটি একসময় বিলুপ্তই হয়ে যায়।
অন্যদিকে গণতান্ত্রিক যুবলীগ কিন্তু দাঁড়াতেই পারল না, তার বিলুপ্তিটা ঘটে গেল একেবারে সূচনাতেই। কারণ সংগঠনটি বিশ্বাস করত ধর্মনিরপেক্ষতায় ও সমাজতন্ত্রে। শুরুতে তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানও সংগঠনটির সঙ্গে কিছুটা যুক্ত ছিলেন; কিন্তু তিনি এর আদর্শকে সমর্থনযোগ্য মনে করেননি। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন যে, গণতান্ত্রিক যুবলীগের কার্যকরী কমিটির সভা ডাকা হয়েছিল ময়মনসিংহে, এবং সে সভায় ‘অনেক তর্কবিতর্ক হলো, তারপর যখন দেখলাম যে, কিছুতেই শুনছে না, সকলেই প্রায় কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন বা তাদের সমর্থকরা উপস্থিত হয়েছে তখন বাধ্য হয়ে আমরা সভা ত্যাগ করলাম। আর বলে এলাম, মুসলিম লীগের কোনো কর্মী আপনাদের এই ষড়যন্ত্রে থাকবে না। যুবলীগও আজ থেকে শেষ।’ ঠিক সে রকমটাই কিন্তু ঘটেছিল। উদ্যোক্তারা অবশ্য নিশ্চেষ্ট থাকেননি; রাষ্ট্রীয় বাধা-নিষেধ ও হুমকি-ধমকি লঙ্ঘন করে শহরে জায়গা না পেয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমান নৌকায় মিলিত হয়ে তারা পাকিস্তান যুবলীগ নামে নতুন একটি সংগঠন গঠন করেন। এটি ঘটে, ১৯৫১ সালে, ২৭ মার্চ।