‘কায়দা করে বেঁচে থাকো’—বছর কয়েক আগে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সীমানাপ্রাচীরে এ রকম একটা দেয়াললেখন চোখে পড়ত। তখন করোনা মহামারি শুরু হয়নি, তবে এ দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ তখনো কায়দা করে বেঁচে থাকার সঙ্গে নানাভাবে পরিচিত ছিল। ইতিহাসে বারবার এখানে বহিরাগত শাসকদের বদল হয়েছে। লুণ্ঠনে, অপশাসনে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর একই ধরনের গল্প তাই ওপরতলার গুটিকয়েকের বাদ দিয়ে প্রায় সবারই। স্বাধীন দেশেও সেই চিত্র বদলায়নি। বলা চলে, অপশাসন, মারি, মড়ক, মন্বন্তরের সঙ্গে লড়তে লড়তেই মানুষকে এখানে কায়দা করে বেঁচে থাকার নানা কৌশল রপ্ত করে নিতে হয়েছে।
মহামারি শুরুর প্রথম দিকে বিশ্লেষকেরা তথ্য-উপাত্ত, বিশ্লেষণ, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও অকাট্য যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন, কত বড় মহাবিপর্যয় এ দেশের জনগণের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু কি যেন এক তুকতাকের বলে সেই আশঙ্কার বেশির ভাগটাই উড়িয়ে দিয়েছিলেন এ দেশের সাধারণ মানুষ। প্রায় কোনো ধরনের সহযোগিতা না পাওয়ার পরও কীভাবে উতরে গেছেন তাঁরা এত বড় একটা দুর্যোগ, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। তবে এই তুকতাক আর কিছু নয়, কায়দা করে বেঁচে থাকা। কম খেয়ে, কম পরে কিংবা শিক্ষা, চিকিৎসা বা জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কাটছাঁট করে টিকে থাকার কৌশল।
মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে বড় আঘাতটা জীবিকার ওপর গিয়ে পড়ে। বাংলাদেশের নিম্নপুঁজির যেসব মানুষ স্বল্প পুঁজি নিয়ে কায়দা করে জীবন চালাতেন, তাঁরা এখন তাঁদের জীবিকার সম্বলটা টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। তাঁরা কেউই জানেন না এর পরের কায়দাটা কী হতে চলেছে।
কায়দা করে বেঁচে থাকার এই কৌশল আপত্কালীন বা সাময়িক সময়ের জন্য হলে মানুষ তা সহ্য করে নিতে পারে, কিন্তু সেটা স্থায়ী রূপ পেলে, অনিবার্যভাবেই এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। করোনা মহামারিকালে এ দেশের সিংহভাগ মানুষ যেখানে কায়দা করে টিকে গিয়েছিল, এখন ইউক্রেন যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতায় সেখানে কায়দা করে বেঁচে থাকার পরের কায়দাটা কী হবে, তার চিন্তায় দিশাহারা। এবারেও যথারীতি লড়াইটা তাদের নিজেদের। বরং সরকার একলাফে তেলের দাম ৪০-৫০ বাড়িয়ে দেওয়ার মতো এমন সব তুঘলকি সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে বালির বাঁধের মতো তাদের কায়দাগুলো ধসে পড়েছে।
আবার সরকারের নীতিগুলো গ্রিক পুরাণের সাইক্লপসের মতো এমন একচোখা যে তাতে তাদের ক্ষমতাতন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত লোকদের সম্পদ বাড়ে শনৈঃশনৈঃ করে। প্রতিবছরই গুণিতক হারে কোটিপতি বাড়ে। আর গুণিতকের বহু গুণিতক হারে সম্পদ হারাচ্ছে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তরা। ফলে যত দিন গড়াচ্ছে, ততই প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতম হয়ে পড়ছে দেশের মোট জনসংখ্যার বিপুল একটা অংশ। জ্বালানি তেলের একধাপে মূল্যবৃদ্ধি কিংবা সব ধরনের নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত কত মানুষ নিচের ধাপে নেমে পড়ছে, এর কোনো পরিসংখ্যান কিংবা জরিপ কি সরকার করছে? কিন্তু মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটা এখন আশপাশে কারও সঙ্গে কথা বললেই যে কারোরই বুঝতে অসুবিধা হবে না।