পত্রিকায় দেখলাম, বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার রায়বাঘিনি ইউএনও মেহরুবা ইসলামকে সরকার তড়িঘড়ি করে ঢাকা বিভাগে নিয়ে এসেছেন এতদঞ্চলে কোথাও পদায়ন করার জন্য। সরকার হয়তো ভেবেছেন, একটি দূরবর্তী অনগ্রসর এলাকায় এ রকম একজন ‘বিপজ্জনক’ অফিসারকে রাখা ঠিক হবে না : তিনি আজ সর্বসমক্ষে ফুটবল খেলার ট্রফি আছাড় মেরে গুঁড়ো করেছেন, কাল যে খেলোয়াড়, রেফারি, এমনকি দর্শকদের মেরে তক্তা বানাবেন না তার নিশ্চয়তা কী! খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে তাঁর বাসায় কাচের তৈজসপত্রের ব্যবহার অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়ে পিতল-কাঁসা-অ্যালুমিনিয়াম-প্লাস্টিক চালু হয়েছে। এতে আশপাশের লোকজন নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়লেও রোজ রোজ কাচের গ্লাস-পেয়ালা-পিরিচ কেনার খরচ তো বেঁচেছে!
ট্রফি ভাঙার খবরটা পত্রিকায় পড়ে সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের চাকরিজীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ল। পাকিস্তানি আমলের শেষ দিকে আমি তখন পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শেখপুরা জেলার শাহদারাতে মহকুমা প্রশাসক।
আমার ডিসি ছিলেন আমার চেয়ে সাত বছরের সিনিয়র ১৯৫৯ ব্যাচের আমারই মতো এক সিএসপি অফিসার। ভদ্রলোক ছিলেন পেশোয়ার অঞ্চলের এক বিরাট ধনী পাঠান পরিবারের সন্তান। সবাই বলত, তিনি নাকি ছিলেন ‘সর্বগুণে গুণান্বিত’। আবার বদরাগীও বটে। কাজেকর্মে মনোযোগ ছিল না বললেই চলে। তা একদিন তাঁর অফিসের সম্মেলন কক্ষে তিনি আমাদের নিয়ে মিটিং করছিলেন। বিভিন্ন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে বিচারকদের বিচারকার্যের অবস্থা পর্যালোচনা করা হচ্ছিল সেই মাসিক সভায়। ডিসি সাহেবের সামনে বিরাট খতিয়ানে প্রত্যেক বিচারকের কার্যসম্পাদনের বিবরণী দেওয়া ছিল। তিনি ওটা দেখে দেখে এক একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নাম ধরে ডাকছিলেন এবং সেই সঙ্গে চলছিল জবাবদিহি। এক ভদ্রলোকের পারফরম্যান্স দেখেই ‘বস্’ রাগে ফেটে পড়লেন। ‘এই মিয়া, তুমি তো দেখছি একটা আস্ত ফাঁকিবাজ। অফিসে বসে সারাদিন নিশ্চয়ই আড্ডা দাও, এজলাসে দয়া করে ওঠো না। ’ ওই বিচারক বেচারা কিছু বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু ‘বস্’ তখন রাগে অন্ধ হয়ে গেছেন। ‘গত মাসে তোমার ফাইলে যে কটা মামলা পেন্ডিং বলে উল্লেখ ছিল এ মাসেও তাই। ইউ ইডিয়ট। ’ বলতে বলতে ‘বস্’ সেই বিচারককে হাতের কাছে না পেয়ে তাঁর (বিচারক) জন্য বরাদ্দকৃত একটা বিরাশি সিক্কা ওজনের কিল দুম করে বসিয়ে দিলেন সামনের টেবিলে রাখা কাচের ওপর। অমনি ওই পুরু কাচ ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেল। আর পাঠানপুঙ্গব ডিসি মহোদয় রাগে কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এরই ভেতর সেই বিচারকের ক্ষীণকণ্ঠ শোনা গেল : স্যার, আপনি প্লিজ পরের কলামটি দেখুন। গত মাসের সব মামলা যে আমি নিষ্পত্তি করেছি তা ওই কলামে শো করা আছে। শুনে ফর্সা খান সাহেবের রাঙা মুলার মতো চেহারা এক নিমেষে নীললোহিত হয়ে গেল। তিনি আমাকে বললেন, ‘করিম, বাকি মিটিং তুমি চালিয়ে নাও। আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। ’ বলতে বলতে তিনি দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন সভাকক্ষ থেকে। ওই সময় শেখপুরা জেলায় সিনিয়রিটির দিক থেকে ডিসির পরেই ছিলাম আমি। ডিসি সাহেব তাই আমাকেই কাজ চালিয়ে যেতে বলে চলে গেলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর শুরু হলো হাসি-ঠাট্টা। মিয়া ফয়েজ করিম নামে একজন প্রৌঢ় এডিএম ছিলেন। বেশ মজার লোক ছিলেন তিনি। তিনি বলে উঠলেন : সবই তো হলো, কিন্তু এই কাচের দাম কে দেবে? আপনি তো এখন সভাপতি। এর সিদ্ধান্ত আপনাকেই দিতে হবে। বলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন দুষ্টুমির হাসি।